পড়াশোনা

সিরাজগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস

বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার নামকরণের পেছনে লুকিয়ে আছে একটি বিশেষ ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভূগোল-নির্ভর তাৎপর্য। সিরাজগঞ্জ জেলার নামকরণও তেমনই একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে।সিরাজগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাসযা এ অঞ্চলের সমাজ সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এক সময়কার গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর হিসেবে খ্যাত এই অঞ্চলটি ছিল বাণিজ্য ও সংস্কৃতির এক প্রাণকেন্দ্র। সিরাজগঞ্জ নামটি মূলত ‘সিরাজ’ নামের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম থেকে উদ্ভূত,

যার অবদান এই এলাকার বিকাশে ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। এই আর্টিকেলে আমরা সিরাজগঞ্জ নামকরণের ইতিহাস অনুসন্ধানের মাধ্যমে জেলার ঐতিহাসিক পরিচিতি, প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

সিরাজগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস?

বেলকুচি থানার একজন প্রভাবশালী ভূস্বামী (জমিদার) ছিলেন সিরাজউদ্দিন চৌধুরী। তিনি তার নিজস্ব মহালে একটি গঞ্জ স্থাপন করেন এবং তা তার নামানুসারে “সিরাজগঞ্জ” নামে অভিহিত করা হয়।

তবে সেই গঞ্জটি তেমন প্রসিদ্ধি লাভ করতে পারেনি। পরবর্তীতে যমুনা নদীর ভাঙনের ফলে এই স্থাপনাটি ধীরে ধীরে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় এবং অঞ্চলটি উত্তর দিকে সরে যেতে থাকে।

এই প্রেক্ষাপটে, ১৮০৯ সালের দিকে সিরাজউদ্দিন চৌধুরী ‘খয়রাতি মহল’ হিসেবে ভূতের দিয়ার নামক একটি মৌজা জমিদারি সেরেস্তায় লিখিত নিলামের মাধ্যমে ক্রয় করেন।

তিনি এই স্থানটিকে বাণিজ্য ও ব্যবসার উপযোগী মনে করে এখানে নতুনভাবে কেন্দ্র স্থাপন করেন। তখন পূর্বে তার নামে নামকরণ করা সিরাজগঞ্জ অঞ্চলটি আবারও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।

ফলে ভূতের দিয়ার মৌজাটিকেই তিনি “সিরাজগঞ্জ” নামে নতুনভাবে নামকরণ করেন। এই নামকরণের মাধ্যমে ভূতের দিয়ার মৌজাই চূড়ান্তভাবে “সিরাজগঞ্জ” নামে পরিচিতি লাভ করে এবং এই নামটিই স্থায়ী রূপ পায়।

প্রাক-মধ্যযুগ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ

সপ্তম শতাব্দীর পর ময়মনসিংহের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল বর্তমান সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, ফরিদপুর ইত্যাদি অঞ্চল বছরের আট-নয় মাস পানির নিচে থাকত। ফলে জনবসতি কম ছিল।

বর্ষা শেষে শুকনো মৌসুমে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে কৃষক ও মেহনতি মানুষ জমি আবাদ করতে আসতেন। তারা একত্রিত হয়ে বন্যা প্রতিরোধে বাঁধ বা ‘জাংগাল’ নির্মাণ করত। এসব বাঁধ এলাকার জলাভূমি ক্রমে বসতিতে রূপ নিত।

ধারণা করা হয়, এখান থেকেই ‘সমতট’ শব্দের উৎপত্তি। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ও ইতিহাসবিদ কালিদাস নাগ পূর্ব বঙ্গের নিম্নাঞ্চলকে ‘সমতট’ নামে অভিহিত করেছেন, যার মধ্যে ময়মনসিংহ এবং এর দক্ষিণ-পশ্চিমের সমভূমি এলাকাগুলি পড়ে।

প্রাচীন ও মধ্যযুগ

শশাঙ্কের শাসন (৬১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত)

বঙ্গদেশে শশাঙ্ক রাজত্ব করেন। তিনি বঙ্গবাসীর সম্রাজ্য গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং আংশিক তা বাস্তবায়ন করেন।

সালিম শাহ ও পাবনার সংযোগ

শেরশাহ সূরীর পুত্র সলিম শাহ (১৫৪৫-১৫৫৩ খ্রিষ্টাব্দ) দিল্লির মসনদে আরোহণ করেন। তিনি পাবনা জেলার চাইমোহর থানার সমাজ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, যা সিরাজগঞ্জের ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।

ভাট অঞ্চল ও পদবির উৎপত্তি

পাল রাজাদের সময় শাসকদের ‘ভাট’, ‘লাট’, ‘চাট’ ইত্যাদি উপাধি প্রদান করা হত। ধারণা করা হয় ‘ভাট’ শব্দ থেকেই যমুনা ও পদ্মা নদী পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ‘ভাটের দেশ’ নামে পরিচিতি পায়।

ইসলামের প্রভাব ও মুসলিম শাসন

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি

১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা বিজয় করেন এবং এই অঞ্চলে মুসলিম শাসনের সূচনা হয়।

ইবনে বতুতা ও মাহুয়ান

মুসলিম বিজয়ের ১৫০ বছরের মধ্যে সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে ইসলাম ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। চৈনিক দূত মাহুয়ান উল্লেখ করেন, সিরাজগঞ্জের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান এবং সততা ও স্বাধীনচেতা মনোভাবের জন্য খ্যাত ছিলেন।

হযরত শাহ জালাল (রঃ) ও অন্যান্য সুফি সাধকদের আগমন

এই সময়ে সুফি সাধকদের আগমন ঘটে। যেমনঃ কাগমারীতে শাহ জালাল (রঃ) ও বাবা আদম (রঃ), শাহজাদপুরে শাহ দৌলা (রঃ), সিরাজগঞ্জে শাহ সিরাজউদ্দিন (রঃ) প্রমুখ।

মুঘল আমল (১৫৩৮-১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দ)

প্রশাসনিক কাঠামো

মুঘল আমলে সুবা বাংলা ১৯টি সরকার ও ৬৮২টি পরগণায় বিভক্ত ছিল। সিরাজগঞ্জ ‘সরকার বাজুহা’র অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও লোককাহিনি

তখন যমুনা নদী ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী। বর্তমান সিরাজগঞ্জ শহর ছিল একটি ভয়ানক স্থান বলে মনে করা হতো, যাকে ‘ভুতের দিয়ার’ নামে ডাকা হতো। এখনো মৌজা নাম হিসেবে এই নাম টিকে আছে।

বৃটিশ আমল

প্রশাসনিক রূপান্তর

১৭৮৭ সালে মোমেনশাহী জেলা গঠিত হয় এবং সিরাজগঞ্জ তাতে অন্তর্ভুক্ত হয়। সিরাজ আলী চৌধুরী বড় বাজু পরগনার সাত আনা অংশ নিয়ে ‘সিরাজগঞ্জ জমিদারী’ প্রতিষ্ঠা করেন।

থানা ও মহকুমা প্রতিষ্ঠা

১৭৯০ সালে সিরাজগঞ্জসহ কিছু স্থানে প্রথম থানা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পেশ করা হয় এবং ১৭৯২ সালের মধ্যে তা বাস্তবায়ন হয়। ১৮৪৫ সালে জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ মহকুমা গঠিত হয়।

আরও পড়ুনঃ নাটোর জেলার নামকরণের ইতিহাস

জেলার অন্তর্ভুক্তি

১৮৫৫ সালে যমুনা নদীর প্রবাহ পরিবর্তনের ফলে সিরাজগঞ্জ থানা পাবনা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৭৫ সালে রায়গঞ্জ থানাও সিরাজগঞ্জ মহকুমায় যুক্ত হয়।

আধুনিক কাল ও জেলা গঠন

জেলা প্রতিষ্ঠা

১৯৮৪ সালে দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও প্রশাসনিক বিবেচনায় সিরাজগঞ্জ জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

শেষ কথা

সিরাজগঞ্জ জেলার ইতিহাস নদীনির্ভর ভূপ্রকৃতি, রাজনৈতিক পরিবর্তন, ধর্মীয় প্রভাব এবং প্রশাসনিক বিকাশে সমৃদ্ধ। প্রাচীন ‘ভাটের দেশ’ থেকে শুরু করে আধুনিক জেলা গঠনের ইতিহাস এ অঞ্চলের জনগণের সংগ্রাম, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি বহন করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button