ঝালকাঠি জেলার নামকরণের ইতিহাস
প্রতিটি অঞ্চলের নামকরণের পেছনে থাকে একটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জনগণের জীবনের প্রতিচ্ছবি। ঝালকাঠি জেলার নামকরণও ব্যতিক্রম নয়। নদীনির্ভর জীবনযাত্রা, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পেশা সবকিছু মিলিয়ে
‘ঝালকাঠি’ নামটির উৎপত্তি একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার ফসল। সুগন্ধা নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই জনপদ একসময় ছিল জেলে সম্প্রদায়ের প্রধান আবাসস্থল।স্থানীয় ভাষা, পেশাভিত্তিক কার্যকলাপ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে “ঝালকাঠি” নামটি সময়ের পরিক্রমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস,
লোককথা এবং ঐতিহ্যের অনন্য অধ্যায়, যা জেলার সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক পরিচয়কে গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ঝালকাঠি জেলার নামকরণের ইতিহাস?
ঝালকাঠী নামটির উৎপত্তি জেলে (কৈবর্ত) সম্প্রদায়ের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। পূর্বে সুগন্ধা নদীর দক্ষিণ তীরে ছিল পোনাবালিয়া এবং উত্তর পাড়ে উজিরপুরের শিকারপুর। এই দুই অঞ্চলের মাঝে ছিল বিস্তীর্ণ নদী।
স্থানীয় মেহেদীপুরের জেলেদের সঙ্গে বিরোধের ফলে তারা বাসন্ডা ও ধানহাটা খালের তীরে কাটাবাখারী জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি গড়ে তোলে। জেলেরা গাছ কেটে (কাঠি) জাল তৈরি করত, সেই থেকে “জাল” + “কাঠি” মিলে “ঝালকাঠি” নামটির উৎপত্তি হয়।
অনুরূপভাবে স্থানীয় আরও কিছু স্থানের নাম যেমনঃ চাঁদকাঠী, কৃঞ্চকাঠী, চরকাঠী, বিনয়কাঠী ইত্যাদির প্রাচীন ইতিহাসও রয়েছে। এসব অঞ্চল স্বরূপকাঠী পর্যন্ত বিস্তৃত।
প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস
বিশ্বরূপ সেনের এক তাম্রলিপিতে ঝালকাঠী ও নৈকাঠীর নামোল্লেখ পাওয়া যায়। ১২০৫ সালে রায়েরকাঠী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মদনমোহনের পুত্র শ্রীনাথ রায় সম্রাটের কাছ থেকে জমির পাট্টা লাভ করেন।
মদনমোহন তার জমিদারি কেন্দ্র স্থাপন করেন বর্তমান ঝালকাঠী থানার নথুল্লাবাদ গ্রামে। তার পৌত্র রাজা রুদ্রনারায়ণ জঙ্গলে জগদম্বার মূর্তি পেয়ে রায়েরকাঠীতে রাজধানী স্থাপন করেন।
পরবর্তীতে পাঠান যুবক আগাবাকের খাঁ’র সঙ্গে জমি দখল নিয়ে সংঘর্ষ হয়, যা সুতালরী ও বারৈকরন গ্রামে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রূপ নেয়। এই যুদ্ধে ২২টি কামান ফেলে আগাবাকের খাঁ পালিয়ে যায়।
ইংরেজ ও নীলকরদের উপস্থিতি
ঝালকাঠীর বন্দর এলাকায় ১৮৪৫ সাল পর্যন্ত নীলকররা বসবাস করত এবং এখানে নীল চাষ শুরু করে। একবার নীলচাষীদের দাসপ্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘটে এবং এক নীলকর সাহেব নিহত হন। আজও তার সমাধি ঝালকাঠী সরকারি বিদ্যালয়ের পাশে দেখা যায়।
বন্দর ও বানিজ্যিক গুরুত্ব
পর্তুগিজ নাগরিক মি. উড ও ইউয়াট ১৭৫৭ সালের পর এখানে লবণ স্টেটের এজেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হন। রাজা সত্যসরন ঘোষালের নেতৃত্বে ঝালকাঠী একটি সমৃদ্ধ বানিজ্য বন্দর হিসেবে গড়ে ওঠে।
তিনি রাজপ্রাসাদসদৃশ অট্টালিকা ও জলাশয় নির্মাণ করেন, যা বন্দরকে আরো উন্নত করে তোলে। একসময় এটিকে ‘দ্বিতীয় কলকাতা’ বলা হতো।
আরও পড়ুনঃ জামালপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস
প্রশাসনিক পরিবর্তন ও জেলা প্রতিষ্ঠা
১৭৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর মি. ম্যাসি কর্তৃক ইস্ট ইন্ডিয়া সরকারে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে ঝালকাঠী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করা হয়। সেই বছর এটি বাখরগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়।
পরে ১৯৮২ সালে ঝালকাঠীকে জেলা ঘোষণা করা হয় এবং ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পূর্ণাঙ্গ জেলার মর্যাদা পায়।