মাগুরা জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলার ইতিহাস, ভূগোল ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে তার প্রতিটি জেলার নাম ও নামকরণের পেছনের গল্প। এই নামগুলো শুধু ভৌগোলিক পরিচয়ের বাহক নয়।বরং অঞ্চলটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, জনশ্রুতি, ভাষাগত রূপান্তর এবং পরিবেশ-প্রকৃতিরও প্রতিফলন ঘটায়। তেমনি মাগুরা জেলার নামকরণের ইতিহাসও একটি বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক ও জনশ্রুতিভিত্তিক ধারাবাহিকতা বহন করে।
সময়ের পরিক্রমায় এই জেলার নাম নিয়ে নানা মতবাদ, কিংবদন্তি ও ভাষাগত বিশ্লেষণ গড়ে উঠেছে, যা মাগুরার ইতিহাস ঐতিহ্যের অনন্য অধ্যায় হিসেবে গণ্য করা যায়।
মাগুরা জেলার নামকরণের ইতিহাস?
মাগুরা নামকরণ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিভিন্ন মত রয়েছে। “খুলনা শহরের আদিপর্ব” গ্রন্থের লেখক ঐতিহাসিক আবুল কালাম সামসুদ্দিনের মতে, মরা গাঙ বা ‘মরগা’ থেকে মাগুরা নামের উৎপত্তি।
স্থানীয় ভাষায় মরগা বলতে মরা নদীকে বোঝায়। অন্য এক মত অনুযায়ী, ধর্মদাস নামের এক মগ জলদস্যু মধুমতি নদীর তীরে বসতি স্থাপন করে, যার কারণে এলাকাটি মগদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে।
এই ‘মগ’ ও ‘মরগা’ শব্দের সমন্বয়ে ‘মাগুরা’ নামের উদ্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। একটি প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী, এক সময়ে মাগুরার খাল-বিলে প্রচুর মাগুর মাছ পাওয়া যেত।
সেই মাছে ভরপুর অঞ্চলের নামই পরে হয়ে ওঠে “মাগুরা”। এই জনশ্রুতিটিও জনপ্রিয় এবং অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। গঙ্গা নদীর প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন গঙ্গা রাষ্ট্রে সভ্যতা বিস্তৃতি লাভ করে।
ধীরে ধীরে মিথিলা, পৌণ্ড্রবর্ধন ও বঙ্গ প্রভৃতি অঞ্চলে আর্যদের উপনিবেশ গড়ে ওঠে। বর্তমান মাগুরা জেলা যে ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত, তার গঠন ও বিস্তারে ভাগিরথী ও পদ্মার বিভিন্ন শাখা ও প্রশাখার অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান ও অতীতে মধুমতি (গড়াই), কুমার, নবগঙ্গা, চিত্রা, ফটকি (যদুখালী), হানু, মুচিখালী ও ব্যাঙ নদী দ্বারা বিধৌত এই অঞ্চল ভৌগোলিক ও পরিবেশগতভাবে ছিল সমৃদ্ধ।
মুচিখালী ও গড়াই নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত মাগুরা শহর নবগঙ্গা নদীর তীরে, ঝিনাইদহ শহর থেকে প্রায় ১৭ মাইল পূর্বে। প্রাচীন বুড়োল দ্বীপ ও গঙ্গা দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত এই এলাকা বিজয় সেনের আমলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত ছিল।
ঐতিহাসিকদের মতে, কুমার নদীর মোহনায় এই অঞ্চলে প্রথম জনবসতির সূচনা ঘটে। ১৭৮১ সালে যশোরকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হলে, মাগুরা ছিল যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত একটি অঞ্চল।
সে সময় মাগুরা এলাকায় কোনো থানা বা প্রশাসনিক কাঠামো ছিল না। অপরাধপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত মাগুরায় মগ জলদস্যুদের অত্যাচারে জনজীবন ছিল অতিষ্ট। এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় এবং অপরাধ দমন করার লক্ষ্যে মাগুরায় মহকুমা স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৮৪৫ সালে মাগুরা মহকুমা প্রতিষ্ঠা পায় এবং পরে ১৮৭৫ সালের ১৬ নভেম্বর মাগুরা সদর থানাও স্থাপিত হয়। এর আগে শালিখা থানা ১৮৬৭ সালে, মহম্মদপুর থানা ১৮৬৯ সালে এবং শ্রীপুর থানা ১৮৭৯ সালে স্থাপিত হয়।
প্রায় ১৪০ বছর ধরে এই চারটি থানা নিয়ে মাগুরা যশোর জেলার অধীনে একটি মহকুমা হিসেবে টিকে থাকে।মাগুরার প্রথম মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মি. কর্কবার্ণ।
শহরের নিচু জমির কারণে জলাবদ্ধতা এড়াতে তিনি নতুনভাবে হাট বসানোর নির্দেশ দেন এবং কয়েকটি পুকুর খননের মাধ্যমে মাগুরা সদরের উঁচু এলাকা উন্নয়নের সূচনা করেন। তার নেতৃত্বে মহকুমা ভবন নির্মিত হয়, যার আশপাশে গড়ে ওঠে শহরাঞ্চল।
আরও পড়ুনঃ হবিগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস
প্রথম প্রশাসনিক ভবনটি ছিল বর্তমান পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের উত্তরে, এবং সেখান থেকেই প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৮ সালে প্রশাসনিক সুবিধার্থে মহকুমা অফিস স্থানান্তরিত হয়ে কলেজ রোডের পূর্ব পাশে বর্তমান স্থানে স্থাপিত হয়।
দীর্ঘদিন ব্যবহৃত পুরনো ভবনটি ‘পুরাতন কোর্ট বিল্ডিং’ নামে পরিচিত ছিল এবং ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ মাগুরাকে জেলা হিসেবে উন্নীত করার পর সেই ভবনটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে রূপান্তরিত হয়।
পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে নতুন জেলা প্রশাসকের অফিস ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ২০০২ সালে তিনতলা ভবন নির্মিত হলে, প্রশাসনের সকল কার্যক্রম সেখানে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে সেখান থেকেই জেলা প্রশাসনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।