বগুড়া জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন জনপদ হলো বগুড়া। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এই অঞ্চল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।বগুড়ার নামকরণও ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। প্রাচীন রাজত্ব, মুসলিম শাসন, উপনিবেশিক শাসন ও আধুনিক প্রশাসনিক বিবর্তনের ধারায় এই জেলার নাম ও পরিচিতিতে এসেছে পরিবর্তন। বগুড়া নামটি কেবল একটি ভৌগোলিক পরিচয় নয়।
বরং এটি বহন করে দীর্ঘ ইতিহাস, শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং ভাষাগত বিবর্তনের সাক্ষ্য। এই আর্টিকেলে বগুড়া জেলার নামকরণের ইতিহাস ও এর অন্তর্নিহিত প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বগুড়া জেলার নামকরণের ইতিহাস?
বগুড়া জেলার ইতিহাস বহু প্রাচীন এবং বৈচিত্র্যময়। খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতকে এই অঞ্চলটি মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মৌর্য শাসনের পর বগুড়া অঞ্চল গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে আসে।
পরবর্তীকালে এই অঞ্চলে শাসন করেন শশাঙ্ক, হর্ষবর্ধন, যশোবর্ধন পাল, মদন এবং সেন রাজবংশের শাসকগণ।
মুসলিম শাসন ও বগুড়া নামের উৎপত্তি?
১৩শ শতকে দিল্লির সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের পুত্র সুলতান নাসির উদ্দিন ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চলের শাসক ছিলেন। তার নামানুসারে এ অঞ্চলের নামকরণ হয় ‘বগড়া’ (ইংরেজিঃ Bogra)।
নাম পরিবর্তন ও আধুনিক রূপ?
যদিও ইংরেজিতে নামটি ‘Bogra’ হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছিল, বাংলায় কালের বিবর্তনে এটি ‘বগুড়া’ রূপে পরিচিতি লাভ করে।
পরবর্তীকালে ২ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) বৈঠকে এই জেলার ইংরেজি নাম ‘Bogra’ থেকে পরিবর্তন করে ‘Bogura’ রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বগুড়া উত্তরবঙ্গের একটি প্রাচীন ও সমৃদ্ধশালী জেলা, যা রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক দিক থেকে বগুড়া বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলা। ‘উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার’ নামে পরিচিত এই শহর শিল্প, বাণিজ্য এবং ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ।
শিল্প ও বাণিজ্য
বগুড়া একটি শিল্পনগরী হিসেবে সুপরিচিত। এখানে ছোট ও মাঝারি আকারের বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শহরের উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারণে এটি দিন দিন আরও শিল্পায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
বগুড়া জেলার ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন এবং গৌরবময়। এটি এক সময় পুন্ড্রবর্ধনের রাজধানী ছিল, যা বর্তমানে মহাস্থানগড় নামে পরিচিত। মহাস্থানগড় বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন নগরী এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত।
শহর থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তরে শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত এই ঐতিহাসিক স্থান এক সময় ‘পুন্ড্রনগর’ নামে পরিচিত ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভারতের রাজা ‘আশকা’ বাংলা বিজয়ের পর এই অঞ্চলের নাম দেন ‘পুন্ড্রবর্ধন’।
পরবর্তীতে মুসলিম শাসন, ব্রিটিশ শাসন ও আধুনিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর দিয়ে বগুড়া তার বর্তমান পরিচয় লাভ করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বগুড়া ছিল ৭ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত, যা জেলার মুক্তিযুদ্ধকালীন গুরুত্বকে নির্দেশ করে।
ভৌগোলিক অবস্থান
বগুড়া শহর করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত। করতোয়া নদী উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে শহরটিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে।
জেলার ভৌগোলিক সীমানা অনুযায়ী উত্তরে গাইবান্ধা ও জয়পুরহাট, পশ্চিমে নওগাঁ, দক্ষিণে সিরাজগঞ্জ এবং পূর্বে যমুনা নদী ও জামালপুর জেলা অবস্থিত।
শহর পরিচিতি
বগুড়া শহরের মোট আয়তন ৭১.৫৬ বর্গকিলোমিটার এবং এটি ২১টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। শহরে আন্তর্জাতিক মানের “শহীদ চান্দু ক্রিকেট স্টেডিয়াম” অবস্থিত, যা ক্রীড়াঙ্গনে বগুড়ার গুরুত্ব তুলে ধরে।
আরও পড়ুনঃ রাজশাহী জেলার নামকরণের ইতিহাস
এছাড়াও সরকারি “জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ” শহরের নিকটেই অবস্থিত, যা চিকিৎসা শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিশেষ খ্যাতি
বগুড়া তার বিখ্যাত দইয়ের জন্য সারাদেশে পরিচিত। সুস্বাদু ও ঐতিহ্যবাহী বগুড়ার দই দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকভাবেও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।