ঢাকা জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলার রাজধানী এবং দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ঢাকা জেলার নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা জনশ্রুতি, ঐতিহাসিক তথ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ।
প্রাচীনকালে বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠা এই অঞ্চলের নাম কীভাবে “ঢাকা” হলো সে প্রশ্নের উত্তর আজও পুরোপুরি নির্দিষ্ট নয়। তবে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মতে, বিভিন্ন সময়ের নানা মতবাদ এই নামের উৎস ব্যাখ্যা করেছে।কারো মতে এটি ধর্মীয় প্রভাবের ফল, আবার কেউ কেউ মুঘল প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড ও ঐতিহ্যবাহী ঢাক বাজানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে নামকরণের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
ঢাকা জেলার নামকরণের ইতিহাস তাই শুধুই একটি শব্দের উত্সানুসন্ধান নয়। এটি এক যুগের রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম, প্রত্নতত্ত্ব ও জন মানুষের ধারাবাহিক চিত্র তুলে ধরে।
ঢাকা জেলার নামকরণের ইতিহাস?
ঢাকার নামকরণের সঠিক ইতিহাস নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা মতভেদ রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঢাকার ইতিহাস নানা ঘটনার সাক্ষী।
নিচে ঢাকার নামকরণ সংক্রান্ত দুটি জনপ্রিয় মতবাদ ও এর আধুনিক ভৌগোলিক বিভাজন আলোচনা করা হলোঃ
হিন্দু পুরাণভিত্তিক মতবাদ
একটি প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে, সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন একবার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভ্রমণে আসেন। সেখানে তিনি সন্নিহিত এক জঙ্গলে হঠাৎ দুর্গা দেবীর একটি বিগ্রহ আবিষ্কার করেন। এই বিগ্রহটি ঢাকা বা গুপ্ত অবস্থায় ছিল।
দেবী দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধাবশত তিনি ঐ স্থানে একটি মন্দির নির্মাণ করেন, যার নাম দেন “ঢাকেশ্বরী মন্দির”। অনেকে মনে করেন, এই মন্দিরের নাম থেকেই পরবর্তীতে পুরো এলাকার নাম “ঢাকা” হয়ে যায়।
মুঘল আমলভিত্তিক মতবাদ
আরেকটি প্রচলিত মতবাদ হলো, মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন ঢাকা শহরকে সুবাহ বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন, তখন সুবাহদার ইসলাম খান শহরের গুরুত্ব ও আনন্দ উদযাপনের প্রতীকস্বরূপ ঢাক বাজানোর আদেশ দেন।
সেই ঢাক বা বাদ্যযন্ত্র বাজানো থেকেই লোকমুখে এই শহরের নাম “ঢাকা” ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখযোগ্য মুঘল শাসনামলের একপর্যায়ে শহরটি সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারে “জাহাঙ্গীরনগর” নামেও পরিচিত ছিল।
আধুনিক ঢাকা ও এর বিভাজন
- বর্তমানে প্রশাসনিক প্রয়োজনে ঢাকা নগরীকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ ও ঢাকা উত্তর।
- ঢাকা দক্ষিণ মূলত পুরাতন ঐতিহাসিক নগরী, যেখানে বহু প্রাচীন স্থাপনা, বাজার ও ঐতিহ্যবাহী স্থান অবস্থিত।
- ঢাকা উত্তর হচ্ছে সম্প্রসারিত নতুন নগর অঞ্চল, যেখানে আধুনিক আবাসন প্রকল্প, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও উপশহর গড়ে উঠেছে।
এইভাবেই নানা ইতিহাস ও জনশ্রুতির ভেতর দিয়ে গড়ে উঠেছে আজকের ঢাকা। ইহা একটি ঐতিহ্যবাহী ও গতিময় নগরী।
ঢাকার প্রাচীন ইতিহাস ও রাজধানী হিসেবে বিবর্তন
ঢাকা শহরের ইতিহাস শুধু মুঘল শাসনকালেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি বহু প্রাচীন ও সমৃদ্ধ জনপদের পরিচায়ক।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ, ঐতিহাসিক দলিল এবং প্রাচীন নিদর্শনের মাধ্যমে আজকের ঢাকা শহরের যে গভীর অতীত রয়েছে, তা ধাপে ধাপে উঠে এসেছে বিভিন্ন গবেষণায়।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে প্রাচীন ঢাকা
পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকালে ‘গ্লেজড মৃৎপাত্র’ এবং ‘রোলেটেড মৃৎপাত্র’ আবিষ্কৃত হয়েছে। এই নিদর্শন থেকে অনুমান করা যায়,
ঢাকায় খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতাব্দীতে একটি সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে উঠেছিল। এ সময়ে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। একই ধরনের মৃৎপাত্র মহাস্থানগড় (প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন), উয়ারী-বটেশ্বর এবং ভারত,
মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও পাওয়া গেছে। এইসব নিদর্শন ঢাকার প্রাচীনত্বকে আড়াই হাজার বছরের বেশি প্রমাণ করে।
প্রাচীন রাজনৈতিক ইতিহাসে ঢাকা
ঐতিহাসিকভাবে ঢাকা প্রথমে সমতট, পরে বঙ্গ এবং গৌড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৩শ শতকের শেষভাগে মুসলমানেরা ঢাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
এরপর ১৫৭৬ থেকে ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্য বারবার বারো ভূঁইয়াদের প্রতিরোধের মুখে পড়লেও শেষ পর্যন্ত সফল হয়।
মুঘল শাসনে রাজধানী ঢাকা
সম্রাট আকবরের আমলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী ছিল বিহারের রাজমহল। কিন্তু বারো ভূঁইয়াদের প্রতিরোধ দমন করে ঢাকাকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খান চিশতীকে সুবেদার নিযুক্ত করা হয়।
তিনি ভৌগোলিক সুবিধা বিবেচনায় ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহল থেকে রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আদেশে সেই সময় ঢাকার নামকরণ হয় “জাহাঙ্গীরনগর”, যা তাঁর জীবদ্দশা পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়।
ইসলাম খান চিশতীর নেতৃত্বে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বারো ভূঁইয়ার পতন ঘটে এবং পুরো সুবা বাংলা চট্টগ্রামের কিছু অংশ বাদে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
রাজধানী স্থানান্তরের ধারাবাহিকতা
- ঢাকা ১৬১০ সালে সুবা বাংলার রাজধানী হলেও এটি দীর্ঘস্থায়ী ছিল না।
- ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে সুবেদার শাহ সুজা রাজধানী আবার রাজমহলে স্থানান্তর করেন।
- শাহ সুজার পতনের পর ১৬৬০ সালে সুবেদার মীর জুমলা আবার ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণা করেন।
- ঢাকায় কিছু সময়ের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে প্রশাসন পরিচালনার পর ১৭১৭ সালে সুবেদার মুর্শিদ কুলি খান রাজধানী মুর্শিদাবাদে সরিয়ে নেন।
এরপর ঢাকায় মুঘল শাসনের আওতায় ‘নায়েবে নাজিম’ শাসকগণ কর্তৃক প্রশাসন পরিচালিত হতো, যা ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত (ব্রিটিশদের ‘স্থায়ী বন্দোবস্ত’ কার্যকর হওয়ার পূর্বে) চলমান ছিল।
আরও পড়ুনঃ বাগেরহাট জেলার নামকরণের ইতিহাস
ব্রিটিশ ও পরবর্তী সময়ে ঢাকার গুরুত্ব?
ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর কলকাতাকে রাজধানী হিসেবে নির্বাচিত করা হলে ঢাকার গুরুত্ব হ্রাস পায়। কিন্তু ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ঢাকা আবার তার পূর্বের গুরুত্ব ফিরে পায়।
ওই বছর ঢাকা আসাম ও পূর্ব বাংলার রাজধানী হয়। তবে কংগ্রেসের প্রবল বিরোধিতার কারণে ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার পুনরায় রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তর করে।
এইভাবেই ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে ঢাকা এক সময়ের প্রাচীন জনপদ থেকে শুরু করে বারবার রাজধানী হওয়ার মধ্য দিয়ে নিজের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করে। আজকের ঢাকা সেই ইতিহাসের ধারাবাহিক উত্তরসূরি।