হবিগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত হবিগঞ্জ জেলা একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ জনপদ। এ জেলার নামকরণকে ঘিরে রয়েছে ধর্মীয় প্রভাব, প্রাচীন জনবসতির স্মৃতি এবং মুসলিম সাধক ও জমিদারদের কীর্তি।ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, এই জেলার নামের উৎপত্তি হয়েছে “হবিবগঞ্জ” শব্দ থেকে। ১৮শ শতকে সুফি সাধক হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর একজন অনুসারী সৈয়দ নাছির উদ্দিন (রহঃ) এর বংশধর
সৈয়দ হবিব উল্লাহ খোয়াই নদীর তীরে একটি গঞ্জ অথবা বাজার স্থাপন করেন। তাঁর নামানুসারেই এই বাজারের নামকরণ হয় “হবিবগঞ্জ” যার অর্থ ‘হবিবের গঞ্জ’ বা বাজার।
কালের পরিক্রমায় শব্দটি রূপান্তরিত হয়ে “হবিগঞ্জ” নাম ধারণ করে। এই নামের মাঝে লুকিয়ে আছে এ অঞ্চলের প্রারম্ভিক জনপদের আত্মপ্রকাশ, ধর্মীয় প্রভাব ও ব্যবসা বাণিজ্যের বিকাশের ইতিহাস।
হবিগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস?
সুফি সাধক হযরত শাহজালাল (রঃ) এর অনুসারী সৈয়দ নাছির উদ্দিন (রঃ) এর স্মৃতি বিজড়িত খোয়াই, করাঙ্গী, সুতাং, বিজনা, রত্না প্রভৃতি নদীবিধৌত অঞ্চলটি আজকের হবিগঞ্জ।
ঐতিহাসিক সুলতানসী হাবেলীর প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ সুলতানের বংশধর সৈয়দ হেদায়েত উল্লাহর পুত্র সৈয়দ হবিব উল্লাহ খোয়াই নদীর তীরে একটি গঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নামানুসারে জায়গাটির নাম হয় ‘হবিবগঞ্জ’, যা কালক্রমে ‘হবিগঞ্জ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাস: চাকলাপুঞ্জী
চাকলাপুঞ্জী চা বাগানের নিকটবর্তী চান্দির মাজার সংলগ্ন বালু নদীর তীরে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যেমনঃ জীবাশ্ম কাঠ ও হস্তনির্মিত অস্ত্র প্রমাণ করে যে এই অঞ্চলে প্রাচীন মানবসমাজের বসবাস ছিল।
প্রাগৈতিহাসিক যুগে এটি লালমাই পাহাড়, সিলেট, চট্টগ্রাম ও মধুপুরের উঁচু অঞ্চলসমূহের সাথে সংযুক্ত ছিল।
মুঘল-বারো ভূইয়া সংঘর্ষ
১৫শ শতকে বারো ভূইয়ার অন্যতম সিলেটের জমিদার আনোয়ার খান ও বানিয়াচংয়ের জমিদার হোসেন খানের সঙ্গে মুঘল সেনাবাহিনীর যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধের উল্লেখ পাওয়া যায় ঐতিহাসিক গ্রন্থ বাহরাস্থান-ই-গায়েবী-তে।
খাজা ওসমান ও পুটিজুরী দুর্গ
আফগান শাসক খাজা ওসমান বাকাইনগর দুর্গ ত্যাগ করে গিরিপাল অঞ্চলের পুটিজুরীতে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন, যা ছিল প্রতিরক্ষার দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পরবর্তীতে তাঁর ভাই দুর্গ ত্যাগ করলে মুঘল বাহিনী সুযোগ নিয়ে দালাম্বপুর (বর্তমান মৌলভীবাজারে) তাঁকে পরাজিত করে।
ব্রিটিশ শাসনকাল ও রেলপথ উন্নয়ন
উপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ সরকার ১৯২৮ সালে হবিগঞ্জ বাজার-শায়েস্তাগঞ্জ-বাল্লা রেলপথ নির্মাণ করে। এই রেলপথ হবিগঞ্জ মহুকুমার অর্থনৈতিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও ২০০৩ সালে এই রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
পৌরসভা প্রতিষ্ঠা
১৬ ডিসেম্বর ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ আমলে সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহুকুমায় ‘হবিগঞ্জ ফাউন্ডেশন’ নামে পৌরসভা অফিস ভবন স্থাপিত হয়।
এটি বর্তমানে ‘পুরাতন পৌরসভা’ নামে পরিচিত এবং হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পুরাতন জজকোর্ট এলাকায় অবস্থিত।
আরও পড়ুনঃ ঠাকুরগাঁও জেলার নামকরণের ইতিহাস
মুক্তিযুদ্ধ ও তেলিয়াপাড়ার ঐতিহাসিক বৈঠক
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ার ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদরদপ্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম সংগঠিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে জেনারেল এম এ জি ওসমানীসহ অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সেদিন যুদ্ধ পরিচালনার জন্য চারজন সিনিয়র অফিসারকে বিভিন্ন অঞ্চলের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এই ঐতিহাসিক সভার স্মরণে ‘তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধ’ নির্মাণ করা হয়েছে।