মৌলভীবাজার জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত মৌলভীবাজার জেলা একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা অঞ্চল, যা চা-বাগান, পাহাড় ও নদ-নদীতে সমৃদ্ধ। জেলার আয়তন প্রায় ২৭৯৯ বর্গকিলোমিটার।এর উত্তরে সিলেট জেলা, দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে আসাম ও ত্রিপুরা এবং পশ্চিমে হবিগঞ্জ জেলা অবস্থিত।
মৌলভীবাজার জেলার নামকরণের ইতিহাস?
মৌলভীবাজার জেলার নামকরণের পেছনে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের গভীর সংযোগ। কথিত আছে, মহান সুফি সাধক হযরত সৈয়দ শাহ্ মোস্তফা (রঃ) এর ভাতুষ্পুত্র
হযরত ইয়াছিন (রঃ) এর বংশধর মৌলভী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ ১৮১০ খ্রিষ্টাব্দে মনু নদীর তীরে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মপরায়ণ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি সমাজে “মৌলভী” উপাধিতে পরিচিত ছিলেন।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাজারটি ক্রমে “মৌলভীবাজার” নামে পরিচিতি পায় এবং স্থানীয়ভাবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক ও সামাজিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে এই বাজারকে কেন্দ্র করেই ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দের ১ এপ্রিল ব্রিটিশ প্রশাসন ২৬টি পরগনা নিয়ে দক্ষিণ শ্রীহট্ট মহকুমা প্রতিষ্ঠা করে।
এটি ছিল বৃহত্তর সিলেট জেলার একটি প্রশাসনিক উপ-একক। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে “দক্ষিণ শ্রীহট্ট” নামের পরিবর্তে স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত মৌলভীবাজার নামটিই জনপ্রিয়তা পায়।
অবশেষে, ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে মহকুমার নাম আনুষ্ঠানিকভাবে “দক্ষিণ শ্রীহট্ট” থেকে পরিবর্তন করে “মৌলভীবাজার” রাখা হয়, যা ঐতিহাসিক সত্য ও স্থানীয় ঐতিহ্যের প্রতিফলন।
এরপর দীর্ঘ ২৪ বছর পর, ১৯৮৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, মৌলভীবাজার মহকুমাটিকে পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে ঘোষিত করা হয়।
প্রাচীন ইতিহাস
মৌলভীবাজার তথা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল বহু প্রাচীনকাল থেকেই পবিত্র ভূমি হিসেবে পরিচিত। রামায়ণ ও মহাভারতের মতো প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্যেও এই অঞ্চলের উল্লেখ রয়েছে।
ইতিহাস গ্রন্থে পাওয়া যায়, মৌলভীবাজারের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কিছু অংশ ছাড়া অবশিষ্ট অঞ্চলটি এক সময় কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সুলতানি আমল
১৩০১ সালে বাংলার সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের শাসনামলে এই অঞ্চল মুসলমানদের অধীনে আসে। আরবের ইয়েমেন থেকে আগত মহান সুফি সাধক হযরত শাহজালাল (রঃ) এর সিলেট আগমনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রসার লাভ করে।
তাঁর অন্যতম সঙ্গী হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (রঃ) ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে মৌলভীবাজারে আসেন এবং এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। তিনি বাগদাদ থেকে আগত ছিলেন এবং মৌলভীবাজার শহরের প্রাণকেন্দ্রে তাঁর মাজার অবস্থিত।
মোগল আমল
মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে মৌলভীবাজার অঞ্চল একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। সম্রাট আকবরের সময় ইটা রাজ্যের রাজা সুবিদ নারায়ণের মৃত্যুর পর, ১৬১০ সালে পাঠান বীর খাজা ওসমান ইটা রাজ্য অধিকার করেন।
১৬১২ সালে মোগল সেনাপতি ইসলাম খানের আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ অঞ্চলের একচ্ছত্র শাসক হিসেবে অবস্থান করেন।
ব্রিটিশ আমল
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার অবসান ঘটে এবং ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়। ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ সরকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করে, যার ফলে জমিদার ও মিরাসদার শ্রেণীর সৃষ্টি হয়।
আরও পড়ুনঃ শেরপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস
এই শ্রেণিরা সাধারণ কৃষকের উপর খাজনা আদায়ের ভার গ্রহণ করে অত্যাচার শুরু করে। ফলে জনগণের উপর শোষণ চরমে পৌঁছে। এই অবস্থা বিরুদ্ধেই মৌলভীবাজারের মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হন।
১৮৫৭ সালের ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহে মৌলভীবাজার অঞ্চলের সৈন্যদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে ২৩ ডিসেম্বর ‘লাতু’ নামক স্থানে বিদ্রোহী সেনারা ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে মুখোমুখি হয়েছিলেন, যা এই অঞ্চলের স্বাধীনতাকামী চেতনার নিদর্শন।
শেষ কথা
মৌলভীবাজার জেলার ইতিহাস একটি বর্ণাঢ্য উত্তরাধিকার বহন করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্বে ভরপুর এই জেলা প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত একাধিক রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সাক্ষী। এ জেলার প্রতিটি স্তরে ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় খুঁজে পাওয়া যায়।