পাবনা জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন জেলা সমূহের মধ্যে পাবনা একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। এই জেলা তার সমৃদ্ধ ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং রাজনৈতিক জাগরণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
তবে পাবনা জেলার পরিচিতির পেছনে যে বিষয়টি সর্বাগ্রে আলোচনার দাবি রাখে, তা হলো জেলার নামকরণের ইতিহাস। নাম একটি ভূখণ্ডের পরিচয়ের অন্যতম উপাদান, যা তার অতীত, সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত।পাবনা নামটি কোথা থেকে এসেছে, কীভাবে এই নামের উৎপত্তি ঘটেছে তা নিয়ে নানা মত ও কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। এই নামকরণ শুধু একটি শব্দের ব্যাখ্যা নয়। বরং তা জড়িয়ে আছে জনপদের ঐতিহাসিক পরিচয় ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের ধারার সঙ্গে।
এই আর্টিকেলে আমরা পাবনা জেলার নামের উৎপত্তি বিষয়ে প্রচলিত বিভিন্ন মত, ইতিহাস ও লোককথার আলোকে একটি বিশ্লেষণ উপস্থাপন করার চেষ্টা করব, যা এই অঞ্চলের পরিচিতিকে আরও গভীরভাবে অনুধাবনে সহায়তা করবে।
পাবনা জেলার নামকরণের ইতিহাস?
পাবনা জেলার নামকরণ নিয়ে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মধ্যে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। এর উৎপত্তি নিয়ে বহু যুগ ধরে নানা তত্ত্ব প্রচলিত আছে, যেগুলো ভাষাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচিত হয়েছে।
একজন খ্যাতিমান প্রত্নতত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার কানিংহামের ধারণা অনুসারে, প্রাচীন পুন্ড্র বা পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের নাম থেকেই ‘পাবনা’ নামটির উদ্ভব হয়েছে। পুন্ড্রবর্ধনের জনপদটি গঙ্গা নদীর উত্তরদিকে অবস্থিত ছিল।
ভাষার প্রাকৃতিক রূপান্তরের ধারায় ‘পুন্ড্রুবর্ধন’ বা ‘পৌন্ড্রবর্ধন’ উচ্চারিত হতে হতে ‘পোনবর্ধন’ কিংবা ‘পোবাবর্ধন’ এবং পরবর্তীতে সহজরূপে ‘পাবনা’ নামে রূপান্তরিত হয়েছে।
অন্য একটি মত অনুযায়ী, ‘পাবনা’ নামটি এসেছে ‘পদুম্বা’ নামক এক প্রাচীন জনপদের নাম থেকে। এই জনপদের প্রথম ঐতিহাসিক উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে পাল রাজা রামপালের শাসনামলে।
ইতিহাসবিদদের মতে, রামপাল তার হৃতসাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারে ১৪ জন সামন্ত রাজাকে সহায়তা চেয়েছিলেন, যাদের একজন ছিলেন পদুম্বার সোম নামক এক সামন্ত। সময়ের সাথে সাথে ‘পদুম্বা’ শব্দটি ধ্বনিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘পাবনা’ হয়ে যায়।
আরও একটি মত অনুযায়ী, ‘পাবনা’ নামটি উদ্ভূত হয়েছে এক সময়ের berknown দস্যু ‘পাবন’ বা ‘পাবনা’র নামে, যিনি এই অঞ্চলে তার আড্ডা স্থাপন করেছিলেন। স্থানীয় লোককথায় এ মতটি প্রচলিত। এছাড়াও কেউ কেউ মনে করেন,
গঙ্গা নদীর একটি শাখা ‘পাবনী’ নদীর স্রোতধারার নামানুসারেই ‘পাবনা’ নামটির উৎপত্তি হয়েছে। এই বিভিন্ন মতবাদ আমাদের জানায় যে পাবনার নামকরণ শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট উৎস থেকে নয়। বরং ইতিহাস, ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট ও ভাষাগত বিবর্তনের সমন্বয়ে গঠিত একটি বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া।
পাবনা জেলার ইতিহাস (১৮২৮–১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ)
১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর পাবনাকে একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তার আগে, বিশেষ করে ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের দিকে, জেলার অধিকাংশ অঞ্চল রাজশাহী জেলার অংশ ছিল।
সে সময় গ্রামীণ এলাকাগুলোতে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীর অভাব, পুলিশের অযোগ্যতা এবং জমিদারদের অনৈতিক আচরণের কারণে আইনশৃঙ্খলা চরম অবনতির দিকে যায়।
ডাকাতেরা দলে দলে ঘুরে বেড়াত এবং চলনবিল অঞ্চলে জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য ছিল ব্যাপক। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসনিক সংস্কারের অংশ হিসেবে কোম্পানি সরকার ১৮২৮ সালে পাবনায় একজন জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে।
১৮৩২ সালে এ পদ স্থায়ী করা হয় এবং একজন স্বতন্ত্র ডেপুটি কালেক্টর নিয়োগ দেওয়া হয়। শুরুতে রাজশাহী জেলার পাঁচটি থানা (খেতুপাড়া, মথুরা, শাহজাদপুর, রায়গঞ্জ ও পাবনা) এবং যশোর জেলার তিনটি থানা (ধরমপুর, মধুপুর ও কুষ্টিয়া) নিয়ে পাবনা জেলা গঠিত হয়।
১৮২৮ সালের ২১ নভেম্বর যশোরের খোকসা থানাকে পাবনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে, বিভিন্ন সময়ে জেলার সীমানা পরিবর্তিত হয়েছে। এ সময়ে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার ম্যাজিস্ট্রেট এ ডব্লিউ মিলস পাবনায় জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিযুক্ত হন।
১৮৩৭ সালে সেশন জজের পদ সৃষ্টি হলে পাবনা জেলা রাজশাহীর দায়রা জজের অধীনস্থ হয়। ১৮৪৮ সালের ১৭ অক্টোবর জেলার পূর্ব সীমা নির্ধারিত হয় যমুনা নদী দ্বারা।
১৮৫৫ সালের ১২ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জ থানা ময়মনসিংহ জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাবনায় যুক্ত করা হয় এবং ১৮৬৬ সালে সিরাজগঞ্জকে মহকুমায় উন্নীত করা হয়। এরপরে ২০ বছর পর রায়গঞ্জ থানা পাবনার অন্তর্ভুক্ত হয়।
নীল বিদ্রোহ চলাকালে শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতির প্রেক্ষিতে লর্ড ক্যানিং ১৮৫৯ সালে পাবনায় একজন কালেক্টর নিয়োগ দেন। এর আগে ১৮৫৭ সালে টি.ই. রেভেন্স জেলা প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন।
১৮৬৯ সালে সিরাজগঞ্জ এবং ১৮৭৬ সালে পাবনায় পৌরসভা (মিউনিসিপ্যালিটি) গঠিত হয়। ১৮৮৫ সালে জেলা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫৮ সালে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটলে এই জেলা বৃটিশ সম্রাজ্ঞী রানী ভিক্টোরিয়ার শাসনাধীনে যায়।
১৮৫৯ সালে পাংশা, খোকসা ও বালিয়াকান্দি থানা নিয়ে পাবনার অধীনে কুমারখালী মহকুমা গঠিত হয়। ১৮৬৩ সালে কুষ্টিয়া থানা পাবনা জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৮৭১ সালের মে মাসে পাংশা ফরিদপুর জেলার গোয়ালন্দ মহকুমায় এবং কুমারখালী কুষ্টিয়া মহকুমার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এতে করে পদ্মা নদী জেলার দক্ষিণ সীমানা হিসেবে নির্ধারিত হয়। ১৮৭৯ সালে পাবনায় জজ আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়।
আরও পড়ুনঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস
পাবনা নামের উৎস
পাবনা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য না থাকলেও বিভিন্ন মতামত প্রচলিত আছে। খ্যাতনামা প্রত্নতত্ত্ববিদ কানিংহাম মনে করেন, প্রাচীন পুন্ড্র বা পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের নাম থেকেই ‘পাবনা’ নামের উদ্ভব হয়ে থাকতে পারে।
আবার এক সাধারণ বিশ্বাস অনুযায়ী, ‘পাবনী’ নামের একটি নদীর স্রোতধারার মিলনস্থল হিসেবে এই এলাকার নাম ‘পাবনা’ হয়েছে।