পিরোজপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার নামের পেছনে রয়েছে একটি বিশেষ ঐতিহাসিক কিংবা সাংস্কৃতিক পটভূমি, যা সেই অঞ্চলের অতীত ইতিহাস, লোককথা ও সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
পিরোজপুর জেলার নামকরণও তেমনই এক চমকপ্রদ ইতিহাস বহন করে। এ জেলার নামের উৎপত্তি নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানা মত ও জনশ্রুতি, যা জেলার অতীত শাসনব্যবস্থা, ভূ-প্রকৃতি এবং মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।বিশেষত ফিরোজ সরদার নামক এক প্রভাবশালী জমিদার শাসকের স্মৃতিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এ জেলার নামকরণের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। তাঁর কর্মপ্রচেষ্টা, বীরত্ব এবং আত্মত্যাগ পিরোজপুর নামটির পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই প্রেক্ষাপট থেকেই পিরোজপুর জেলার নামকরণ ইতিহাসের আলোকে বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে, যা আমাদের অতীত চেতনা ও অঞ্চলভিত্তিক পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে।
পিরোজপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস?
কারো কারো মতে, ফিরোজ সরদার নামে একজন ঐতিহাসিক জমিদার শাসক এই অঞ্চলের গভীর বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে মানুষের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করেন। তাঁর উদ্যোগেই এখানে মানববসতির সূত্রপাত ঘটে।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, ১৭৫৩ সালে তিনি নবাববাড়িতে শহীদ হন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এলাকাটি ‘ফিরোজপুর’ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীকালে কালের আবর্তে এবং স্থানীয় উচ্চারণের প্রভাবে
‘ফিরোজপুর’ নামটি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে ‘পিরোজপুর’ নাম ধারণ করে, যা আজও প্রচলিত। সুন্দরবনের কোলঘেঁষা, সবুজে মোড়া প্রাকৃতিক লীলাভূমি পিরোজপুর জেলা কালীগঙ্গা, বলেশ্বর, দামোদর ও সন্ধ্যা নদী বিধৌত এক বৈচিত্র্যময় জনপদ।
ভৌগোলিকভাবে পিরোজপুর জেলার উত্তরে গোপালগঞ্জ, উত্তর-পূর্বে বরিশাল ও ঝালকাঠী, দক্ষিণ-পশ্চিমে বাগেরহাট এবং দক্ষিণ-পূর্বে বরগুনা জেলা অবস্থিত। এই জেলার এক প্রান্তে লবণাক্ত পানি এবং অপর প্রান্তে মিঠা পানির অস্তিত্ব একে অনন্য বৈশিষ্ট্য দিয়েছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বাকেরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন নদীগর্ভে ছোট ছোট দ্বীপাঞ্চল সৃষ্টি হতে থাকে এবং দক্ষিণাঞ্চলের বনভূমি পরিষ্কারের মাধ্যমে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
তবে এই পরিবর্তনের পাশাপাশি ভূমি বিরোধ, কৃষক বিদ্রোহ এবং জলদস্যুদের উপদ্রবও বেড়ে যায়। বিশেষ করে পিরোজপুর অঞ্চলের নদীগুলিতে ডাকাতি, লুণ্ঠনসহ বিভিন্ন অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
এ সকল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য পিরোজপুরকে একটি মহকুমা হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এইচ. এ. আর. আলেকজান্ডার, তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, ১৮৫৬ সালের ২৪ এপ্রিল পিরোজপুরে মহকুমা স্থাপনের প্রস্তাব দেন।
এবং ১৮৫৯ সালের ২৮ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে পিরোজপুর মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ ও কচুয়া পিরোজপুর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা পরবর্তীতে ১৮৬৩ সালে বাগেরহাট মহকুমা হিসেবে যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়।
পরবর্তী সময় বিভিন্ন প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের ফলে পাথরঘাটা, বামনা, কাঠালিয়া ও বানারীপাড়া আলাদা উপজেলায় পরিণত হয়। মহকুমা প্রতিষ্ঠার পর প্রশাসনিক কাঠামো শক্তিশালী করতে বিভিন্ন দপ্তর ও প্রতিষ্ঠান স্থানান্তর করা হয়।
যেমনঃ পাড়েরহাট বন্দর থেকে থানা, কাউখালী থেকে মুন্সেফি আদালত ইত্যাদি। উল্লেখযোগ্যভাবে, ১৮৬৫ সালে পিরোজপুরে দাতব্য চিকিৎসালয়, সাব-রেজিস্টার অফিস, পৌরসভা, মাইনর স্কুল (পরে উচ্চ বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত)
এবং ১৮৯৩ সালে নারীদের জন্য আরবান ইংলিশ গার্লস হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৪ সালে পিরোজপুর মহকুমাকে পূর্ণাঙ্গ জেলায় রূপান্তর করা হয়। এই সময়কালে ১৮৮৫ সালে পিরোজপুর পৌরসভারও প্রতিষ্ঠা ঘটে, যা জেলার প্রশাসনিক কাঠামোকে আরও সুসংগঠিত করে।
নামকরণের ইতিহাস?
পিরোজপুর জেলার নামকরণ নিয়ে জনশ্রুতি ও ঐতিহাসিক কাহিনি উভয়ই রয়েছে। একটি প্রচলিত মতানুসারে, ফিরোজ সরদার নামের এক জমিদার এই অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলেন।
তিনি ১৭৫৩ সালে নবাববাড়িতে শহীদ হন এবং তাঁর নামানুসারে অঞ্চলটি ‘ফিরোজপুর’ নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে ভাষার রূপান্তরে এই নাম ‘পিরোজপুর’ এ রূপ নেয়।
আরেকটি জনশ্রুতি অনুসারে, বাংলার সুবেদার শাহ্ সুজা আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলার নিকট পরাজিত হয়ে দক্ষিণাঞ্চলে পালিয়ে এসে কিছুদিন বর্তমান নলছিটি উপজেলার সুগন্ধা নদীর পারে কেল্লা নির্মাণ করে অবস্থান করেন।
আরও পড়ুনঃ হবিগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস
মীর জুমলার বাহিনী আক্রমণ করলে শাহ্ সুজা পালিয়ে আরাকানে যান, কিন্তু তার স্ত্রী ও শিশু পুত্র থেকে যান। পরবর্তীতে তারা দামোদর নদীর তীরে বসতি স্থাপন করেন এবং সেই শিশুপুত্রের নাম ছিল ফিরোজ। তাঁর নাম থেকেই ফিরোজপুর নামটি উৎপত্তি লাভ করে
এবং কালের পরিক্রমায় তা ‘পিরোজপুর’ হয়ে ওঠে। এই অঞ্চলের ইতিহাস, নদীভিত্তিক জীবনব্যবস্থা, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি এবং বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য মিলিয়ে পিরোজপুর একটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জেলা হিসেবে চিহ্নিত।
“ফিরোজ শাহের আমল থেকে ভাটির দেশের ফিরোজপুর,
বেনিয়া চক্রের ছোঁয়াচ লেগে পাল্টে হলো পিরোজপুর।”
“পলি মাটির ঊর্বরা ক্ষেত শ্যামল সবুজ শষ্য ভরা,
মৎস্য, কৃষি, ফল সম্পদে এ জেলা তাই সবার সেরা।”