পড়াশোনা

জয়পুরহাট জেলার নামকরণের ইতিহাস

ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়, গৌড়ের পাল ও সেন রাজাদের শাসন সম্প্রসারিত ছিল বর্তমান জয়পুরহাট অঞ্চলে। পালবংশীয় রাজা ধর্মপালের পর তার দুই ভাই রাজত্ব করেন, যাদের মধ্যে দেবপাল ছিলেন অন্যতম।

দেবপালের পর রাজা হন জয়পাল, যিনি পাল সাম্রাজ্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী শাসক ছিলেন। জনশ্রুতি ও ইতিহাসবিদদের মতে, এই জয়পাল রাজার নামানুসারেই ১৮০০ সালের দিকে এই অঞ্চলের নামকরণ হয় জয়পুরহাট।জয়পুরহাট জেলার নামকরণের ইতিহাসতার আগ পর্যন্ত এই অঞ্চল স্থানীয়ভাবে বাঘাবাড়ি নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তী সময়ে সরকারি দলিলপত্রে এই নাম পরিবর্তিত হয়ে গোপেন্দ্রগঞ্জ নামে লেখা হতে থাকে।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে, বিশেষ করে ১৮৫৭ থেকে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই সংকট মোকাবেলায় ব্রিটিশ সরকার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

এর অংশ হিসেবে ১৮৮৪ সালে জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতা পর্যন্ত প্রায় ২৯৬ মাইল দীর্ঘ রেললাইন স্থাপন করা হয়। মালামাল পরিবহণ সহজ করতে এই রেলপথে ৪ থেকে ৭ মাইল অন্তর অন্তর স্টেশন স্থাপন করা হয়।

জয়পুর অঞ্চলের ওপর দিয়ে রেলপথটি অতিক্রম করার সময়, এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন স্থাপন করা হয়। চূড়ান্তভাবে এই রেলস্টেশনের নামকরণ করা হয় “জয়পুরহাট”,

যা তখনকার জয়পুর গভর্নমেন্ট ক্রাউন স্টেট নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এবং রাজস্থানের জয়পুর শহরের সঙ্গে বিভ্রান্তি এড়াতে “হাট” শব্দটি যুক্ত করে রাখা হয়। এই “হাট” যুক্ত করার আরেকটি কারণ ছিল

স্টেশনের পাশে অবস্থিত জনবহুল বাজারটি, যেটি স্থানীয়ভাবে পরিচিত ছিল “যমুনার হাট” নামে। ফলে, ‘জয়পুর’ ও ‘হাট’ শব্দ দুটি মিলিয়ে স্টেশন, পোস্ট অফিস ও আশপাশের এলাকা একত্রে পরিচিত হতে থাকে জয়পুরহাট নামে।

এইভাবে ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক বিবর্তনের ধারায় আজকের জয়পুরহাট জেলার নামকরণ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা রাজা জয়পাল থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক যুগের রেলপথ উন্নয়নের ইতিহাসকে ধারণ করে।

জয়পুরহাট জেলার নামকরণের ইতিহাস?

ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত জয়পুরহাটের ইতিহাস অত্যন্ত অনির্ধারিত এবং অস্পষ্ট। কারণ ঐ সময়ে জয়পুরহাট একটি স্বতন্ত্র ভৌগোলিক একক হিসেবে পরিচিত ছিল না। অঞ্চলটি প্রাচীন গৌড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং পাল ও সেন রাজাদের শাসনাধীন ছিল দীর্ঘকাল ধরে।

প্রাচীন নাম ও প্রাথমিক প্রশাসনিক কাঠামো

বর্তমান জয়পুরহাটের পুরাতন নাম ছিল বাঘাবাড়ীহাট। পরবর্তীতে কিছু নথিপত্রে একে গোপেন্দ্রগঞ্জহাট নামে উল্লেখ করা হয়। সে সময় “জয়পুরহাট” নামে কোনও স্থান চিহ্নিত পাওয়া যায় না।

জয়পুরহাট সদর ও পাঁচবিবি উপজেলার অংশ নিয়ে একসময় লালবাজার থানা গঠিত হয়। যার অবস্থান ছিল যমুনা নদীর পূর্বতীরে পুরানাপৈল গ্রামে (বর্তমানে করিমনগর)। এখনো স্থানীয়ভাবে থানা ঘাট ও বাজারের ভিটা হিসেবে ঐতিহাসিক স্থানগুলোর পরিচিতি রয়েছে।

উপনিবেশিক শাসন ও নীল চাষের প্রভাব

লালবাজার, ক্ষেতলাল ও বদলগাছী তখন দিনাজপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইংরেজ শাসনামলে এখানে নীলচাষের বিস্তার ঘটে এবং বিভিন্ন স্থানে যেমনঃ খঞ্জনপুর, পলিবাড়ি, পাঁচবিবি প্রভৃতি এলাকায় নীলকুঠি স্থাপন করা হয়।

লালবাজার ছিল সে সময়ের প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র, যেখান থেকে সাধারণ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হতো।

নতুন জেলা গঠনের সূচনা

১৮২১ সালে প্রশাসনিক জটিলতা হ্রাসের লক্ষ্যে রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার কিছু অংশ বিভক্ত করে বগুড়া জেলা গঠন করা হয়।

এই সময় ক্ষেতলাল, বদলগাছী ও লালবাজার থানা দিনাজপুর থেকে পৃথক করে বগুড়ায় সংযুক্ত করা হয়।

ভৌগোলিক পরিবর্তন ও থানা স্থানান্তর

পরবর্তী সময়ে যমুনা নদীর নাব্যতা হ্রাস এবং ভাঙনের কারণে লালবাজার থানা হুমকির মুখে পড়ে। ফলে ১৮৬৮ সালের ১৬ মার্চ থানাটি স্থানান্তরিত হয় খাসবাগুড়ী গ্রামে, যার স্থানীয় নাম ছিল পাঁচবিবি।

পরে রেলস্টেশন প্রতিষ্ঠার সময় থানা দমদমায় স্থানান্তরিত হয় এবং জনপ্রিয়তা ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের কারণে রেলস্টেশন ও থানা উভয়ের নাম রাখা হয় পাঁচবিবি।

পাঁচবিবি নামের উৎস

ধারণা করা হয়, পুরাতন পাঁচবিবিতে পাঁচটি দরগা ছিল, যেগুলোতে মহররম উপলক্ষে তাজিয়া, জারী, সারী, লাঠিখেলা ইত্যাদি পালিত হতো। পাঁচটি দরগায় তাজিয়া রাখার রেওয়াজ থেকে নামকরণ হয় “পাঁচবিবি”।

রেলপথ স্থাপন ও নতুন বসতির বিকাশ

১৮৮৪ সালে কলকাতা থেকে জলপাইগুড়ী পর্যন্ত ২৯৬ মাইল দীর্ঘ রেলপথ স্থাপিত হলে জয়পুরহাট অঞ্চলেও রেলস্টেশন তৈরি হয়। তিলকপুর, আক্কেলপুর, জামালগঞ্জ ও বাঘাবাড়ীতে রেলস্টেশন গড়ে ওঠে।

এর ফলে নদীপথের গুরুত্ব হ্রাস পায় এবং রেলপথকেন্দ্রিক নতুন বসতি গড়ে ওঠে। এই সময় খঞ্জনপুর ও লালবাজার হারিয়ে যেতে থাকে এবং বাঘাবাড়ীহাট ক্রমে পরিচিতি পেতে থাকে।

আরও পড়ুনঃ দিনাজপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস

জয়পুরহাট নামের উৎপত্তি

রেলস্টেশন প্রতিষ্ঠার পর ব্রিটিশ সরকার জয়পুর গভর্ণমেন্ট ক্রাউন স্টেটের নাম অনুসারে রেলস্টেশনের নাম রাখে জয়পুরহাট, যাতে এটি রাজস্থানের জয়পুর থেকে আলাদা হিসেবে চিহ্নিত হয়। পোস্ট অফিসের নামও জয়পুরহাট রাখা হয়, যা অঞ্চলটির স্থায়ী নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।

প্রশাসনিক উন্নয়ন ও জেলা গঠন

১৯০৭ সালে জয়পুরহাটে পৃথক থানা গঠিত হয়। ১৯১৮ সালে থানার নিজস্ব ভবন নির্মাণ হয় এবং ১৯২০ সালে জরিপ রেকর্ডে জয়পুরহাট থানার নকশা অঙ্কিত হয়। খঞ্জনপুর খাসমহাল কাছারী ভবনগুলোতে সরকারি অফিস স্থানান্তরিত হয়।

এবং ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি জয়পুরহাট মহকুমার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। দীর্ঘ প্রশাসনিক বিবর্তনের পর ১৯৮৪ সালে জয়পুরহাট মহকুমা জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button