পড়াশোনা

দিনাজপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস

বাংলাদেশের প্রাচীন জনপদগুলোর মধ্যে দিনাজপুর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এর ভূ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস বহু পুরনো এবং বৈচিত্র্যময়।

নানা সময়ে বিভিন্ন শাসক ও সংস্কৃতির প্রভাবে এই অঞ্চলটি উন্নয়নের নানা ধাপে অগ্রসর হয়েছে। তবে দিনাজপুর নামটির উৎপত্তি ও নামকরণের পেছনে রয়েছে নানা কিংবদন্তি, ইতিহাস ও গবেষণালব্ধ মত।দিনাজপুর জেলার নামকরণের ইতিহাসদিনাজপুর নামটি কীভাবে এলো, এর পেছনে কোন ব্যক্তি, ঘটনা বা সংস্কৃতি কতটা প্রভাব ফেলেছে এসব বিষয়ে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ একদিকে যেমনঃ কৌতূহলোদ্দীপক, অন্যদিকে তেমনি গুরুত্বপূর্ণ।

এই আর্টিকেলে আমরা দিনাজপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো।

দিনাজপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস?

দিনাজপুর জেলা বাংলাদেশের একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক জনপদ, যার প্রশাসনিক ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৭৮৬ সালে। এই জেলার নামকরণ নিয়ে ইতিহাসে বিভিন্ন মতামত ও জনশ্রুতি প্রচলিত আছে।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, দিনাজপুর রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি জনৈক দিনাজ বা দিনারাজ। ধারণা করা হয়, তার নামানুসারেই রাজবাড়ি (বর্তমানে যেটি রাজবাটী নামে পরিচিত) এলাকায় অবস্থিত একটি মৌজার নামকরণ করা হয় “দিনাজপুর”।

এই নাম ধীরে ধীরে পুরো অঞ্চলের পরিচিতি হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগণ ঘোড়াঘাট সরকার (Ghughudanga Sarkar) বাতিল করে নতুন প্রশাসনিক অঞ্চল গঠনের উদ্যোগ নেন।

সেই প্রেক্ষিতে ১৭৮৬ সালে দিনাজপুরকে একটি পৃথক জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রাজার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে ব্রিটিশ শাসকগণ নতুন জেলার নামকরণ করেন “দিনাজপুর”।

এইভাবে দিনাজপুর জেলার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্থানীয় শাসক, জনসাধারণের শ্রুতি এবং ব্রিটিশ প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের সমন্বিত ইতিহাস। দিনাজপুর অঞ্চল প্রাচীনকাল থেকেই রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি জনপদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

এ অঞ্চল মগধ, গৌড়, কামরূপ, কুচবিহার, নেপাল ও ভুটানের সীমানা ঘেঁষে ছিল বলে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি অত্যন্ত কৌশলগত অবস্থানে অবস্থিত। ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজী যখন লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে বাংলার উত্তরাঞ্চল দখল করেন,

তখন তিনি দিনাজপুরের দেবকোটে মুসলিম শাসনের সূচনা করে বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেন। দেবকোটে রাজধানী ছিল ১২২০ সাল পর্যন্ত, এর পরে তা গৌড়ে স্থানান্তরিত হয়।

চেহেলগাজীদের আগমন ও ইসলামের প্রচার

চেহেলগাজী বা চল্লিশ গাজী ছিলেন ইসলামের প্রচারক এবং যোদ্ধা, যারা রাজা গোপালের রাজত্বকালে দিনাজপুরে আসেন। তাঁরা ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। রাজা গোপালের সেনাদের সঙ্গে এক ভয়াবহ যুদ্ধে তাঁরা শহীদ হন

এবং তাঁদের স্মৃতিতে গড়ে ওঠে চেহেলগাজী মাজার, যা এখন দিনাজপুর শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থান। দিনাজপুরের গড়মল্লিকপুর ও খানসামার দুহসুহ গ্রামেও রয়েছে দীর্ঘ সমাধি গঞ্জে শহীদ ও চেহেলগাজী নামে পরিচিত।

ইলিয়াস শাহ ও রাজা গণেশের শাসন

দিনাজপুরে অবস্থিত একডালা দুর্গ নির্মাণ করেন স্বাধীনতা রক্ষায় ইলিয়াস শাহ। রাজা গণেশ, যিনি গৌড়ের সিংহাসন দখল করেছিলেন, ছিলেন দিনাজপুরের অধিবাসী। তাঁর পুত্র যদু ইসলাম গ্রহণ করে জালালউদ্দীন নাম নেন এবং গৌড় শাসন করেন।

ইসমাইল গাজী ও ঘোড়াঘাটের গৌরব

গৌড়ীয় সেনাপতি ইসমাইল গাজী কামতারাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট বিজয় করেন এবং এখানে মুসলিম নগরীর গোড়াপত্তন করেন। আজও ঘোড়াঘাটে বহু আউলিয়া ও পীরের মাজার রয়েছে।

এখানকার ঐতিহাসিক সূরা মসজিদ, জিন্দাপীরের মাজার এই মুসলিম স্থাপত্য ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের নিদর্শন বহন করে।

প্রাচীন মসজিদ ও ইসলামী স্থাপত্য

সুলতান বরবক শাহের আমলে নির্মিত মসজিদ, চেহেলগাজী মাজার সংলগ্ন প্রাচীন মসজিদ, হোসেন শাহী ও শেরশাহী আমলের মসজিদ ও স্থাপত্য আজও দিনাজপুরের ধর্মীয় ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে।

দিনাজপুর রাজপরিবার

লোকশ্রুতি অনুসারে দিনারাজ বা দিনাজ নামক ব্যক্তি এই রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা, যার নামানুসারেই ‘দিনাজপুর’ নামকরণ হয়। মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে কাশী ঠাকুর নামের একজন সন্ন্যাসী দিনাজপুর ও মালদা অঞ্চলের মালিক হন।

তিনি রাজা গণেশের বংশধর বলে দাবী করেন। তিনি নিজের জমিদারি কায়স্থ শিষ্য শ্রীমন্ত দত্ত চৌধুরীর নামে উইল করে যান। তাঁর দৌহিত্র সুখদেব জমিদারি উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন এবং সেটি দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া ও মালদায় বিস্তৃত করেন।

সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৭৭ সালে তাঁকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র প্রাণনাথ ১৭২২ সালে বিখ্যাত কান্তজিউ মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন, যা ১৭৫২ সালে রামনাথ সম্পন্ন করেন। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মন্দিরটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়,

যা পরবর্তীকালে গিরিজানাথ রায়বাহাদুর সংস্কার করেন। জমিদারি বিলুপ্ত হয় ১৯৫০ সালের ইস্ট বেঙ্গল এস্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যাক্ট অনুযায়ী। রাজপরিবারের শেষ উত্তরাধিকারী জগদীশনাথ ১৯৬২ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

আরও পড়ুনঃ কুড়িগ্রাম নামকরণের ইতিহাস

ব্রিটিশ শাসনের সূচনা ও প্রশাসনিক বিন্যাস

১৭৬৫ সালে ইংরেজ সেনাপতি মিস্টার কোট্রিল ঘোড়াঘাটের শেষ ফৌজদার করম আলী খানকে পরাজিত করে দিনাজপুরে ইংরেজ শাসনের সূচনা করেন। ১৭৮৬ সালে দিনাজপুর একটি জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৭৯৩ সালে এর সদর দপ্তর দিনাজপুরে স্থাপিত হয়। দিনাজপুরের প্রথম কালেক্টর মিস্টার এইচ. জে. হ্যাচের সময়ে বাহাদুরবাজার এলাকায় গোলকুঠি বাড়িতে কালেক্টরেট ভবন নির্মাণ করা হয়।

১৮৩৩ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে দিনাজপুরের কিছু অংশ পূর্ণিয়া, রংপুর ও রাজশাহী জেলার সাথে একত্রিত ও বিচ্ছিন্ন হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button