পড়াশোনা

পঞ্চগড় জেলার নামকরণের ইতিহাস

পঞ্চগড় বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন জনপদ, যার অগ্রযাত্রা বহু যুগ ধরে আর্বতন ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এবং আজও তা অব্যাহত রয়েছে।পঞ্চগড় জেলার নামকরণের ইতিহাসএই জেলার নামকরণ ঘিরে যেমনঃ রয়েছে নানান মতবাদ ও ঐতিহাসিক সূত্র, তেমনি এর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমিও বেশ সমৃদ্ধ।

পঞ্চগড় জেলার নামকরণের ইতিহাস?

পঞ্চগড় নামটির উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, এই অঞ্চলটি প্রাচীনকালে ‘পুন্ড্রনগর’ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল এবং ‘পঞ্চনগরী’ নামে একটি অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘পঞ্চনগরী’ রূপান্তরিত হয়ে ‘পঞ্চগড়’ নাম ধারণ করে। বাংলা ভাষার ধ্বনিগত বিবর্তন অনুযায়ী এটি একটি স্বাভাবিক রূপান্তর, যেখানে শব্দের উচ্চারণ সহজ ও স্বাভাবিক করতে কিছু শব্দ পরিবর্তিত হয়।

‘পঞ্চগড়’ শব্দটি দুটি অংশ নিয়ে গঠিত ‘পঞ্চ’ অর্থাৎ ‘পাঁচ’ এবং ‘গড়’ অর্থাৎ ‘কেল্লা’ বা ‘দুর্গ’। প্রচলিত মতানুসারে, এই অঞ্চলে অবস্থিত পাঁচটি প্রাচীন দুর্গ বা গড়ের সম্মিলন থেকেই পঞ্চগড় নামটির উৎপত্তি।

এই পাঁচটি গড় হলোঃ ভিতরগড়, মীরগড়, হোসেনগড়, রাজনগড় এবং দেবেনগড়। এই পাঁচটি গড় ছিল প্রতিরক্ষা ও প্রশাসনিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যার উপর ভিত্তি করেই জনপদের নামকরণ হয়েছে বলে মনে করা হয়।

তবে আরও একটি ভাষাগত তত্ত্ব রয়েছে, যার ভিত্তিতে বলা হয় ‘পঞ্চগড়’ নামটি এসেছে ‘পঞ্চগৌড়’ শব্দ থেকে। প্রাকৃত ভাষার নিয়ম অনুযায়ী, ‘পঞ্চগৌড়’ > ‘পঞ্চগোড়’ > ‘পঞ্চগড়’ রূপান্তর সম্ভব এবং ভাষার বিবর্তনের স্বাভাবিক ধারায় এটি গ্রহণযোগ্য।

উল্লেখযোগ্য যে, ‘পঞ্চ’ শব্দটি উপমহাদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাননামে ব্যবহৃত হয়েছে যেমনঃ পঞ্চনদ, পঞ্চবটি, পঞ্চগৌড় ইত্যাদি।

প্রাচীন ইতিহাস

পঞ্চগড় একটি প্রাচীন জনপদ হিসেবে পরিচিত। খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ পর্যন্ত এই ভূখণ্ড নানা সভ্যতা ও শাসকগোষ্ঠীর অধীন ছিল। ভৌগোলিকভাবে এটি ছিল মগধ, মিথিলা, গৌড়, নেপাল, ভূটান, সিকিম ও আসাম রাজ্যের সংযোগস্থল,

ফলে এটি রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক দিক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত ছিল। খ্রিস্টীয় ২য় ও ৩য় শতকে রাজা শালিবাহন, রাজা পৃথু এবং রাজা জল্লেশ এই অঞ্চলের শালবাহান ও ভিতরগড় এলাকায় রাজ্য, নগর ও জনপদ গড়ে তোলেন।

তখনকার সময়ে এ অঞ্চল ছিল সমৃদ্ধ ও সুসংগঠিত। মৌর্য, গুপ্ত এবং পাল রাজবংশের শাসকরাও এই অঞ্চল শাসন করেন, বিশেষত ধর্মপাল ও দেবপাল এর সময় পঞ্চগড় ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল।

মধ্যযুগে পঞ্চগড়

মধ্যযুগে পঞ্চগড় অঞ্চলটি মুসলিম শাসকদের দখলে আসে। প্রথম মুসলিম সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন খলজি তাঁর তিব্বত অভিযানকালে এই অঞ্চল দিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

এই অভিযান ইতিহাসে বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত হলেও এতে পঞ্চগড় জনপদের তাৎপর্য ফুটে ওঠে। কিছু ইতিহাসবিদের মতে, সুলতান হোসেন শাহ ও কামতার রাজা নীলধ্বজ এই জেলার তেতুলিয়া থানার দেবনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

এছাড়াও মধ্যযুগে এই অঞ্চলের সঙ্গে সুলতান জালাল উদ্দিন ফাতেহ শাহ, সুলতান বারবক শাহ, আফগান শাসক শেরশাহ, মোগল সম্রাট খুররম খাঁ (পরবর্তীতে শাহজাহান), মীরজুমলা, সুবাদার ইব্রাহীম খাঁ ফতে জঙ্গ এবং জননন্দিত বিদ্রোহী নেতা দেবী চৌধুরাণী, ভবানী পাঠক ও ফকির মজনুশাহের নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

আধুনিক যুগ ও প্রশাসনিক উন্নয়ন

১৬শ শতকে কুচবিহার রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পঞ্চগড় অঞ্চল এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পঞ্চগড় থানাটি দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার অন্তর্ভুক্ত হয়।

এরপর ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি তেতুলিয়া, পঞ্চগড় সদর, আটোয়ারী, বোদা ও দেবীগঞ্জ এই পাঁচটি থানা নিয়ে পঞ্চগড় মহকুমা গঠিত হয় এবং এর সদর দপ্তর পঞ্চগড় থানায় স্থাপিত হয়।

আরও পড়ুনঃ লালমনিরহাট নামকরণের ইতিহাস

এই মহকুমার প্রথম প্রশাসক ছিলেন জনাব সৈয়দ আব্দুর রশিদ, যিনি ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৮২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড় মহকুমাকে পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

এই নবগঠিত জেলার প্রথম জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন জনাব আ.স.ম. আব্দুল হালিম (০১-০২-১৯৮৪ থেকে ১৬-০৬-১৯৮৫)। জেলা ঘোষণার পর থেকেই পঞ্চগড় উন্নয়নের ধারায় এক নতুন যুগে প্রবেশ করে।

শেষ কথা

পঞ্চগড় জেলার নামকরণ ও ইতিহাস যেমন প্রাচীন ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ, তেমনি এর রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বও অপরিসীম। একদিকে যেমনঃ এ অঞ্চলের নামের পেছনে রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষাগত অনুসন্ধান,

তেমনি অন্যদিকে রয়েছে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের পদচিহ্ন। প্রাচীন দুর্গ, শাসনব্যবস্থা, বাণিজ্যপথ এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পঞ্চগড় এক অতীতগৌরবের ধারক ও বাহক।

সময়ের আবর্তনে জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পঞ্চগড় আজও তার ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button