পড়াশোনা

লালমনিরহাট নামকরণের ইতিহাস

বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জেলার নামের পেছনে রয়েছে একটি ইতিহাস, একটি কাহিনি বা কোনো বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। তেমনি উত্তরবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা লালমনিরহাট।

যার নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা জনশ্রুতি, কিংবদন্তি ও ইতিহাসভিত্তিক মতামত। এই জেলার নাম শুধু একটি ভৌগোলিক পরিচয় নয়। বরং এটি হয়ে উঠেছে স্থানীয় ইতিহাস, সংগ্রাম, সাহসিকতালালমনিরহাট নামকরণের ইতিহাসএবং মানুষের আত্মত্যাগের প্রতীক। সময়ের আবর্তে গড়ে ওঠা এই নামের পেছনে রয়েছে রেললাইন নির্মাণের সময় লাল পাথরের আবিষ্কার, জমি দানকারী মহিয়সী নারী লালমনির অবদান এবং এক সাহসী নারীর আত্মত্যাগের করুণ কাহিনি।

এসব মতামতের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে লালমনিরহাট নামকরণের ইতিহাস, যা আজো মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক গৌরবময় ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে আছে।

লালমনিরহাট নামকরণের ইতিহাস?

নিচে লালমনিরহাট নামকরণের ইতিহাস তুলে ধরা হলোঃ

১. রেললাইন নির্মাণকালীন ‘লাল পাথর’ আবিষ্কারের মত

উনবিংশ শতাব্দীতে (১৮০০-এর দশকে) বৃটিশ শাসনামলে বেংগল ডুয়ার্স রেলওয়ে লাইন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এই রেললাইনের কাজের জন্য যখন শ্রমিকরা মাটি খনন করছিল, তখন তারা মাটির গভীরে লালচে রঙের এক ধরনের পাথরের সন্ধান পান।

এই লাল রঙের পাথর স্থানীয়দের মাঝে কৌতূহল ও বিস্ময় সৃষ্টি করে। তারা একে ‘লাল মনি’ বা লাল রত্ন নামে আখ্যায়িত করে। সেই থেকেই ওই স্থানকে ‘লালমনি’ বলা শুরু হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

২. জমিদানকারী নারী ‘লালমনি’র নামে নামকরণ

আরেকটি প্রচলিত মত হলো, বৃটিশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ রেললাইন স্থাপনের জন্য যেসব জমি অধিগ্রহণ করেছিল, তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল একজন মহিলার জমি। ঐ নারীর নাম ছিল লালমনি। তিনি উদারভাবে রেললাইন নির্মাণের জন্য নিজের জমি দিয়ে সহায়তা করেছিলেন।

তাঁর এই উদারতা ও ভূমি দানের স্বীকৃতিস্বরূপ এলাকার মানুষ তাঁর নামেই জায়গাটির নাম রাখে ‘লালমনি’। এটি স্থানীয়দের কাছে একটি সম্মানসূচক ও কৃতজ্ঞতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।

৩. সাহসী নারী যোদ্ধা লালমনির আত্মত্যাগের কাহিনি

তৃতীয় মতটি সবচেয়ে ঐতিহাসিক এবং সংগ্রামী গৌরবে ভরপুর। ১৭৮৩ সালে, কৃষক বিদ্রোহের সময়ে লালমনি নামে এক সাহসী নারী কৃষক নেতা নুরুলদিন এর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে বৃটিশ শাসক ও তাদের সহযোগী জমিদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।

এই বিদ্রোহ ছিল কৃষকদের অধিকার, জমি ও জীবনের নিরাপত্তার জন্য পরিচালিত এক ঐতিহাসিক আন্দোলন। এই সংগ্রামে লালমনি ও নুরুলদিন প্রাণ উৎসর্গ করেন। তাঁদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগ স্মরণে এলাকাবাসী পরবর্তীতে অঞ্চলটির নাম রাখে ‘লালমনি।

আরও পড়ুনঃ লালমনিরহাট জেলার উপজেলা কয়টি

‘হাট’ শব্দের সংযোজন

কালের প্রবাহে, স্থানীয় ব্যবসা ও বাজার কেন্দ্র হিসেবে এই অঞ্চল পরিচিতি পেতে থাকে। ‘লালমনি’ নামের সাথে ‘হাট’ শব্দটি যুক্ত হয়ে গঠিত হয় বর্তমানের ‘লালমনিরহাট’ নামটি।

এখানে ‘হাট’ বোঝায় একটি স্থায়ী বা অস্থায়ী বাজার, যেখানে লোকজন কেনাবেচার জন্য সমবেত হয়। এ অঞ্চলে বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও লোকসমাগম বাড়তে থাকায় ‘হাট’ শব্দটি নামের অংশ হয়ে ওঠে।

শেষ কথা

লালমনিরহাট নামটি শুধু একটি ভৌগোলিক স্থানচিহ্ন নয়। বরং এটি ইতিহাস, সংগ্রাম, সাহসিকতা ও জনমানুষের স্মৃতিকে ধারণ করে।

তিনটি মতই স্থানীয় মানুষের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে, যা এই জেলার নামকরণকে করে তোলে আরও গৌরবময় ও তাৎপর্যপূর্ণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button