ময়মনসিংহ জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলার ঐতিহাসিক জনপদগুলোর মধ্যে ময়মনসিংহ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীন অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। এর ভৌগোলিক অবস্থান, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য একে করেছে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত।
ময়মনসিংহ নামটি কেবল একটি ভৌগোলিক নির্দেশনাই নয়। বরং এটি এক গভীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও জনগণের দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি। এ জেলার নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন জনশ্রুতি, ঐতিহাসিক দলিল ও গবেষণায় ভিন্ন ভিন্ন মতামত পাওয়া যায়।কখনো কোনো সাধকের নাম, কখনো রাজন্যবর্গের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আবার কখনো প্রশাসনিক বিভ্রান্তির ঘটনাও জড়িয়ে আছে এই নামের উৎপত্তির পেছনে।
এই আর্টিকেলে ময়মনসিংহ নামের উৎস ও এর পরিবর্তনের ইতিহাস আলোচনার মাধ্যমে জেলার নামকরণের প্রকৃত প্রেক্ষাপট তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ জেলার নামকরণের ইতিহাস?
ময়মনসিংহ জেলার নামকরণ নিয়ে ইতিহাসে একাধিক মতামত প্রচলিত রয়েছে। মধ্যযুগে এই অঞ্চলে একজন প্রখ্যাত সাধক মোমেনশাহ বসবাস করতেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, তাঁর নামানুসারে এলাকাটির নামকরণ হয় “মোমেনশাহী”।
পরে ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার স্বাধীন সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তাঁর পুত্র সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহ এর জন্য এই অঞ্চলে একটি নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে এই এলাকার নাম হয়ে ওঠে “নসরতশাহী” বা “নাসিরাবাদ”।
পরবর্তীতে নাসিরাবাদ নামটি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিভ্রান্তির কারণে পরিবর্তিত হয়। একবার “বর্জনলাল অ্যান্ড কোম্পানি” কর্তৃক বিশ টিন কেরোসিন বুক করা হয়েছিল নাসিরাবাদ রেল স্টেশনে।
কিন্তু পণ্যটি ভুল করে চলে যায় ভারতের রাজপুতনার নাসিরাবাদ স্টেশনে। এই ভুলের ফলে যথেষ্ট ভোগান্তির সৃষ্টি হয় এবং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বিভ্রান্তি এড়াতে রেলস্টেশনের নাম পরিবর্তন করে “ময়মনসিংহ” রাখা হয়। ধীরে ধীরে সেই নামই এলাকাটির প্রচলিত নাম হয়ে ওঠে।
তবে কিছু ইতিহাসবিদের মতে, এই অঞ্চলের নামকরণের পেছনে আরেকটি ঘটনা রয়েছে। তাঁদের মতে, মুঘল সেনাপতি মনমোহন সিংহ ঈসা খাঁকে দমন করতে গিয়ে এই অঞ্চলে কয়েকদিন অবস্থান করেছিলেন।
তাঁর নাম থেকেই এলাকাটির নামকরণ হয় “ময়মনসিংহ” (মনমোহন সিংহ থেকে বিকৃত রূপ)। এইভাবে ইতিহাস, জনশ্রুতি ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ধারায় নাসিরাবাদ থেকে ময়মনসিংহ নামের উৎপত্তি ঘটে এবং সেটিই আজ স্থায়ী পরিচয়ে পরিণত হয়েছে।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা বাংলাদেশের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল সূতিকাগার। ১৭৮৭ সালের ১ মে জেলা হিসেবে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলেও আধুনিক ময়মনসিংহ জেলার কাঠামো গড়ে উঠে ১৯৮৪ সালে।
ভৌগোলিকভাবে এ জেলা এক বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত উত্তরে গারো পাহাড় ও ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে গাজীপুর জেলা, পূর্বে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে শেরপুর, জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলা দ্বারা বেষ্টিত।
এ ভিন্নতাপূর্ণ ভূপ্রকৃতির কারণে ময়মনসিংহকে নিয়ে একটি প্রবাদই প্রচলিত “হাওর, জঙ্গল, মইষের শিং-এ নিয়ে ময়মনসিং”। ৪,৭৮৭ বর্গমাইল আয়তনের এই রত্নগর্ভা জেলার নামেই প্রকাশ পায় এখানকার প্রাণবন্ত মানুষের পরিচয় “My-men-sing” অর্থাৎ “আমার লোকেরা গান গায়”।
এই নামের মধ্যেই যেন ধ্বনিত হয় এখানকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সংগীতপ্রেমী জনগোষ্ঠির আত্মপরিচয়। ময়মনসিংহের পূর্ব নাম ছিল ‘নাসিরাবাদ’। মোঘল আমলে মোমেনশাহ নামে এক সাধকের নামানুসারে অঞ্চলটির নাম হয় ‘মোমেনশাহী’।
পরবর্তীতে কালের বিবর্তনে এই নাম রূপান্তরিত হয়ে ‘ময়মনসিংহ’ নামে পরিচিতি পায়। ব্রহ্মপুত্র নদ ময়মনসিংহ শহরের পাশ দিয়েই প্রবাহিত। এই নদীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এঁকেছেন অসংখ্য চিত্রকর্ম, যা বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে অনন্য অবদান রেখেছে।
আরও পড়ুনঃ বগুড়া জেলার নামকরণের ইতিহাস
এখানকার বহু স্থাপনায় প্রাচীন নির্মাণশৈলীর নিদর্শন লক্ষ করা যায়, রয়েছে বহু ভগ্ন জমিদার বাড়ি, যেগুলো ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। এ জেলার ত্রিশাল উপজেলার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি।
এখানেই রয়েছে তাঁর স্মৃতিচিহ্ন ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের আয়োজন। সাহিত্য ও সংগীত চর্চার ঐতিহ্য যেমনঃ রয়েছে, তেমনি রয়েছে শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ডের প্রাণবন্ত পরিবেশ।
সার্বিকভাবে ময়মনসিংহ জেলা তার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ হিসেবে সুপরিচিত। এটি শুধু একটি প্রশাসনিক অঞ্চল নয়। বরং একটি ঐতিহ্যবাহী ও সৃজনশীল প্রাণভোমরা, যা যুগ যুগ ধরে বাঙালি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে চলেছে।