পড়াশোনা

বাগেরহাট জেলার নামকরণের ইতিহাস

বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাগেরহাট জেলার রয়েছে এক অনন্য স্থান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শন ও ধর্মীয় সহাবস্থানের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ এ জেলাকে দিয়েছে আলাদা পরিচিতি।

তবে বাগেরহাট নামটির উৎপত্তি ও এর পিছনের ইতিহাস এখনো গবেষণার বিষয়। বিভিন্ন মত ও উপকথার মধ্যে দিয়ে এ নামকরণের ভিন্নতর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, যা এ অঞ্চলের সামাজিক, ধর্মীয় ও ভূ-প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরে।বাগেরহাট জেলার নামকরণের ইতিহাসএই পরিচিতির মূল সূত্রপাত কোথা থেকে, কীভাবে একটি জনপদের নাম হয়ে উঠল ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।এই অনুসন্ধান আমাদের নিয়ে যায় অতীতের গভীরে, যেখানে মিশে আছে হজরত খানজাহান (র.) এর কীর্তি,

প্রাক-ইসলামি সভ্যতার চিহ্ন এবং স্থানীয় জনজীবনের রূপান্তর। এই আর্টিকেল থেকেই আমরা জানতে পারি বাগেরহাট নামকরণের ইতিহাস কতটা বৈচিত্র্যময় ও তাৎপর্যপূর্ণ।

বাগেরহাট জেলার নামকরণের ইতিহাস?

বাগেরহাটের নামকরণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ না থাকলেও কয়েকটি মত প্রচলিত রয়েছে। অনেকের মতে, সুন্দরবনের নিকটবর্তী হওয়ায় এ অঞ্চলে একসময় বাঘের উপদ্রব ছিল,

যার ফলে এ স্থানের নাম হয় ‘বাঘেরহাট’, যা পরবর্তীতে বিবর্তিত হয়ে ‘বাগেরহাট’ নামে পরিচিতি পায়। আবার কারো কারো মতে, হজরত খানজাহান (র.) প্রতিষ্ঠিত ‘খলিফাত-ই-আবাদ’ অঞ্চলের বিখ্যাত ‘বাগ’

বা বাগানসমূহ এতটাই সমৃদ্ধ হয়েছিল যে, সেখান থেকেই ‘বাগের আবাদ’ অর্থাৎ ‘বাগেরহাট’ নামটি উৎপত্তি হয়েছে। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ধারণা অনুসারে, ভৈরব নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত একটি দীর্ঘ বাঁকের কাছে

এক সময় একটি হাট বসতো, যার নাম ছিল ‘বাঁকেরহাট’। কালক্রমে এই নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘বাগেরহাট’ হয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত বাগেরহাট জেলা।

যদিও এই অঞ্চল ভূ-গঠনগতভাবে ততটা প্রাচীন নয়, তথাপি এর ইতিহাস অনেক পুরনো ও সমৃদ্ধ। হজরত খানজাহান (র.)-এর আগমনের বহু পূর্বেই এখানে জনবসতি ছিল বলে ধারণা করা হয়।

তার সময়ে খননকৃত ‘খাঞ্জেলী দীঘি’ থেকে একটি ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তি উদ্ধার হওয়ায় বোঝা যায়, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদেরও এই এলাকায় উপস্থিতি ছিল। বর্তমানে উক্ত মূর্তিটি ঢাকার কমলাপুর বৌদ্ধবিহারে সংরক্ষিত আছে।

১৪৪২-১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলার শাসক নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ-এর আমলে হজরত খানজাহান (র.) বাগেরহাটে আগমন করেন এবং ‘খলিফাত-ই-আবাদ’ নামে একটি জনপদ গড়ে তোলেন।

তিনি ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি বহু মসজিদ, দিঘি, রাস্তা এবং হাটবাজার প্রতিষ্ঠা করেন, যার মধ্যে ষাটগম্বুজ মসজিদ অন্যতম। তার মৃত্যুসন ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ (২৬ জিলহজ, ৮৬৩ হিজরি)।

পরবর্তীতে হোসেন শাহ বংশ এবং বঙ্গেশ্বর নসরত শাহ বাগেরহাট অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন। নসরত শাহের সময় এই অঞ্চলে একটি টাঁকশাল ছিল, যার অবস্থান মিঠাপুকুরের নিকটে বলে মনে করা হয়।

বাগেরহাট ঐতিহাসিকভাবে শুধু ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেই নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাগেরহাট, বিশেষ করে সুন্দরবন অঞ্চল, এক অগ্রণী ও দুর্ভেদ্য ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

প্রশাসনিক ইতিহাস অনুযায়ী, ১৭৮৬ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের আমলে যশোর জেলা গঠিত হয় এবং খুলনা ১৮৪২ সালে যশোর জেলার মহকুমা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। তৎকালীন খুলনার অধীনস্থ বাগেরহাট ছিল একটি থানা।

১৮৪৯ সালে ইংরেজ মোড়েল বংশীয় দুই ব্যক্তি মোড়েলগঞ্জ বন্দর স্থাপন করেন। ১৮৬১ সালের ২৬ নভেম্বর মোড়েল-রহিমুল্লাহ সংঘর্ষের সময় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় খুলনার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন।

আরও পড়ুনঃ নেত্রকোনা জেলার নামকরণের ইতিহাস

এবং তিনি বাগেরহাটে একটি মহকুমা স্থাপনের সুপারিশ করেন। তার ভিত্তিতেই ১৮৬৩ সালে বাগেরহাট যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত একটি মহকুমা হয়। পরবর্তীতে ১৮৮২ সালে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট মহকুমা একত্রিত হয়ে খুলনা জেলা গঠিত হয়।

অবশেষে ১৯৮৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাট মহকুমা জেলায় উন্নীত হয়। বর্তমানে বাগেরহাট জেলা ৯টি উপজেলা, ৭৫টি ইউনিয়ন, ১০৪৭টি গ্রাম এবং ৩টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত একটি ‘এ’ ক্যাটাগরিভুক্ত জেলা। এর সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য আজও গৌরবের সাথে বয়ে চলেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button