পড়াশোনা

নেত্রকোনা জেলার নামকরণের ইতিহাস

বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারায় নেত্রকোনা জেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এর নামকরণের পেছনে রয়েছে ইতিহাস, কল্পকাহিনি ও ভূ-প্রাকৃতিক বাস্তবতার সম্মিলিত প্রভাব।

প্রাচীনকালে এই অঞ্চল ছিল নদীবিধৌত ও জলাভূমি অধ্যুষিত, যেখানে প্রচুর জলাশয়, হাওর ও নদী-নালার অস্তিত্ব ছিল। জনশ্রুতি অনুসারে, “নেত্র” অর্থ চোখ বা দৃষ্টি এবং “কোণা” অর্থ কোণ বা প্রান্ত এই দুটি শব্দের মিলনে ‘নেত্রকোনা’ নামটি গঠিত হয়েছে।নেত্রকোনা জেলার নামকরণের ইতিহাসধারণা করা হয়, এই অঞ্চল এক সময় ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি জনপদ, যা ‘নেত্রের কোণার মতো মনোমুগ্ধকর’ এই অর্থে এর নামকরণ ‘নেত্রকোনা’ হয়েছে।

একটি ভিন্ন মতানুসারে, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী অববাহিকার মিলনস্থলে গড়ে ওঠা ছোট্ট একটি গ্রাম ছিল ‘নেত্রকোনা’, যা পরবর্তীকালে বাণিজ্য ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হয়।

ইংরেজ শাসনামলে অঞ্চলটির প্রশাসনিক গুরুত্ব বাড়তে থাকায় সেই গ্রামের নামেই পুরো মহকুমার নামকরণ করা হয়। ১৮৮০ সালে মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এই অঞ্চল ১৯৮৪ সালের ১৭ জানুয়ারি পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

নামকরণের উৎস যে যাই হোক না কেন, নেত্রকোনা নামটি স্থানীয় ইতিহাস, পরিবেশ ও মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত, যা আজও জেলার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রয়ে গেছে।

নেত্রকোনা জেলার নামকরণের ইতিহাস?

নেত্রকোনা জেলার নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানান জনশ্রুতি, ইতিহাস এবং ভৌগোলিক ব্যাখ্যার মিশেল। প্রচলিত একটি মত অনুযায়ী, নেত্রকোনা শহরের বুক চিরে প্রবাহিত মগরা নদীর বাঁক চোখের বা ‘নেত্রের কোণের’ মতো বলে এই অঞ্চলকে ‘নেত্রকোনা’ নামে অভিহিত করা হয়।

কেউ কেউ মনে করেন, মগরা ও কংশ নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত এই জেলার গঠন অনেকটা চোখের আকৃতির মতো হওয়ায় এই নামটি এসেছে। নদীবিধৌত এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক গঠন ও নদীপথের বক্রতা এলাকাটিকে এমন এক বৈশিষ্ট্য দিয়েছে,

যা “নেত্রের কোণা” বা চোখের কোণার রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আরও একটি ঐতিহাসিক সূত্র পাওয়া যায় বিলু কবীর রচিত গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের জেলা: নামকরণের ইতিহাস’ থেকে।

সেখানে উল্লেখ আছে, নেত্রকোনা শহরের সাত-আট কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ‘নাটোরকোণা’ নামক একটি গ্রামে এক সময় প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো।

কালের পরিক্রমায় এবং কথ্যভাষার রূপান্তরে ‘নাটোরকোণা’ ধীরে ধীরে ‘নেত্রকোনা’ নাম ধারণ করে। নামকরণের এই নানামাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নেত্রকোনার ইতিহাস, ভূপ্রকৃতি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের প্রতিফলন ঘটায়।

প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাসে শেরপুর অঞ্চল

খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে শেরপুর অঞ্চলসহ উত্তর-পশ্চিম ময়মনসিংহ ছিল গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের শাসনামলে এই অঞ্চল কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়।

পরবর্তীতে ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে চৈনিক পরিব্রাজক হিউ এন সাঙ কামরূপ রাজ্যে আগমন করেন হিন্দু রাজা শশাঙ্কের আমন্ত্রণে। সে সময় কামরূপ রাজ্য শাসন করছিলেন নারায়ণ বংশীয় ব্রাহ্মণ কুমার ভাস্করবর্মণ।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে পূর্ব ময়মনসিংহের উত্তরাংশে গারো পাহাড়ে বসবাসকারী বৈশ্য গারো ও দুর্গা গারো নামীয় উপজাতীয়রা তাদের নিজস্ব রাজ্য পরিচালনা করত।

ঠিক এই সময়ে জনৈক মুসলিম শাসক পূর্ব ময়মনসিংহে আক্রমণ চালিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। চতুর্দশ শতাব্দীতে জিতারা নামক এক সন্ন্যাসী কামরূপের রাজধানী ভাটী অঞ্চল আক্রমণ ও দখল করেন।

তবে মুসলিম শাসকেরা তখনও এই অঞ্চলে স্থায়ীভাবে শাসন কায়েম করতে পারেননি। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৩–১৫১৯) ময়মনসিংহসহ পুরো অঞ্চলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

তাঁর পুত্র নসরত শাহ’র শাসনামলে (১৫১৯–১৫৩২) কয়েকটি বিদ্রোহ হলেও তা সফল হয়নি এবং সমগ্র ময়মনসিংহে তাঁর শাসন বলবৎ ছিল। পরবর্তী সময়ে নসরত শাহ এর উত্তরসূরিদের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে।

ফলে ময়মনসিংহ অঞ্চলের উপর থেকে মুসলিম আধিপত্য কিছুটা হ্রাস পায়। এর ফলে অঞ্চলটির উত্তরাংশ কোচদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং দক্ষিণাংশ পাঠান সুলতান শেরশাহ (১৫৩৯–১৫৪৫) এর অধীনে আসে।

আরও পড়ুনঃ সিরাজগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস

তবে শেরশাহর পুত্র সেলিম শাহের শাসনকাল (১৫৪৫–১৫৫৩) ছিল বিদ্রোহ ও অস্থিরতায় পূর্ণ। এই সুযোগে দেওয়ান সোলায়মান খাঁ (যিনি পূর্বে হিন্দু ছিলেন এবং কালিদাস গজদানী নামে পরিচিত ছিলেন) বিদ্রোহ ঘোষণা করে ভাটী অঞ্চল দখল করেন।

যদিও কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রেরিত সৈন্যদের হাতে সোলায়মান খাঁ নিহত হন, তবুও তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ঈশা খাঁ খিজিরপুর থেকে ভাটী অঞ্চলে শক্তিশালী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মুসা খাঁ

এবং আফগান সেনানায়ক খাজা উসমান খাঁ অঞ্চলটি শাসন করতে থাকেন। অবশেষে সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে (১৬০৫–১৬২৭) মোগল সাম্রাজ্যের কর্তৃত্বে সমগ্র ময়মনসিংহ অঞ্চল, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল শেরপুর অঞ্চলটিও, আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়।

ব্রিটিশ শাসনকাল

ব্রিটিশ শাসনামলে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে ১৮৮০ সালে নেত্রকোণা মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তীকালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত ছিল। এরপর ১৯৮৪ সালের ১৭ জানুয়ারি নেত্রকোণাকে পৃথক জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button