ভোলা জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত ভোলা জেলা একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জনপদ হিসেবে পরিচিত। ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং নদীবিধৌত পরিবেশের কারণে অঞ্চলটি প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।
সময়ের পরিক্রমায় এ অঞ্চল বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে। ভোলা জেলার নামকরণ সম্পর্কেও রয়েছে এক গভীর ইতিহাস ও লোককথা।বহুজনের মুখে মুখে প্রচলিত একটি জনশ্রুতি অনুসারে, বেতুয়া নদীর তীরে বাস করা এক প্রবীণ মাঝি ভোলা গাজি পাটনির নাম থেকেই এই অঞ্চলের নামকরণ হয়েছে “ভোলা”।
এই লোকপ্রচলিত ইতিহাস ও প্রাচীন নাম দক্ষিণ শাহবাজপুর থেকে বর্তমান “ভোলা” হয়ে ওঠার পেছনের ঘটনা ও কাহিনীগুলো শুধুই একটি নামের রূপান্তর নয়। বরং এটি একটি জনপদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক রূপান্তরের প্রতিচ্ছবি।
এই আর্টিকেলে আমরা ভোলা জেলার নামকরণ সংক্রান্ত ইতিহাস, জনশ্রুতি ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ভোলা জেলার নামকরণের ইতিহাস?
ভোলা জেলার প্রাচীন নাম ছিল দক্ষিণ শাহবাজপুর। তবে বর্তমানে প্রচলিত “ভোলা” নামটির পেছনে একটি জনপ্রিয় লোককথা রয়েছে। ভোলা শহরের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত একটি খালের নাম বেতুয়া।
এই খালটি অতীতে এতটাই প্রশস্ত ছিল যে, একে “বেতুয়া নদী” বলা হতো। সে সময় খেয়া নৌকার মাধ্যমে মানুষজন এই নদী পারাপার করত। এ অঞ্চলে ভোলা গাজি পাটনি নামে এক বয়স্ক মাঝি খেয়া নৌকা চালিয়ে জনসাধারণকে পারাপার করতেন।
তাঁর বাসস্থান ছিল বর্তমান যোগীর ঘোল এলাকার কাছাকাছি। লোকজনের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম। সময়ের ব্যবধানে তাঁর নামানুসারেই এই অঞ্চলের নামকরণ হয় ভোলা। এই নামকরণ কাহিনীটি স্থানীয় জনগণের মাঝে এখনো বিশেষভাবে প্রচলিত ও সম্মানিত।
ভোলার ইতিহাস: জলদস্যু, প্রশাসনিক রূপান্তর ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
ভোলার প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ অঞ্চল বহু বিদেশি শাসক ও জলদস্যুর নজরে আসে। বিশেষত ১৫০০ সালের দিকে পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুরা এ অঞ্চলে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
১৫১৭ সালে জন ডি সিলবেরা নামক এক পর্তুগিজ জলদস্যু দ্বীপটি দখল করে তার দস্যুবৃত্তির ঘাঁটি স্থাপন করে।পর্তুগিজদের রেখে যাওয়া রোমশ কুকুর এবং তাদের নির্মম অত্যাচারের স্মৃতি আজও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মাঝে ভীতিকর ইতিহাস হিসেবে বেঁচে আছে।
মনপুরা দ্বীপ ছিল তাদের দস্যু কার্যকলাপের মূল কেন্দ্র। এছাড়াও আরাকান ও মগ জলদস্যুরা দক্ষিণ শাহবাজপুরসহ আশপাশের দ্বীপসমূহে ঘাঁটি স্থাপন করে লুটতরাজ চালাত। এ সময় এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনে এক ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করত।
এই দুঃসময়ের প্রতিফলন স্থানীয় লোকসংস্কৃতিতেও পরিলক্ষিত হয়। বলা হয়ে থাকে, সেই সময়েই রচিত হয়েছিল প্রখ্যাত ছড়াটিঃ
> “খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দিব কিসে?
ধান ফুরালো, পান ফুরালো, খাজনার উপায় কী?
আর ক’টা দিন সবুর কর, রসুন বুনেছি।”
প্রশাসনিক ইতিহাস অনুযায়ী, ভোলা শহরের পুরোনো নাম ছিল দক্ষিণ শাহবাজপুর। ১৮২২ সাল পর্যন্ত এটি তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার অংশ ছিল।
পরে মেঘনা নদীর সম্প্রসারণের ফলে জেলা সদর থেকে দক্ষিণ শাহবাজপুরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যাহত হয়। এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ শাহবাজপুর ও হাতিয়াকে নোয়াখালী জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
নোয়াখালী জেলার মহকুমা হিসেবে ভোলা ১৮৪৫ সালে স্বীকৃতি পায়। এবং এর প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল দৌলতখান। এবং ১৮৬৯ সালে ভোলা মহকুমাকে বরিশাল জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়
এবং ১৮৭৬ সালে সদর দপ্তর দৌলতখান থেকে ভোলা শহরে স্থানান্তর করা হয়। তখন থেকেই ভোলা একটি শহরাঞ্চল হিসেবে বিকশিত হতে থাকে। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে ভোলা মহকুমা স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং ভোলা শহর জেলা সদর হিসেবে মর্যাদা পায়।
আরও পড়ুনঃ মৌলভীবাজার জেলার নামকরণের ইতিহাস
ভোলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিও সমৃদ্ধ। প্রাচীন মসজিদ-মন্দিরের স্থাপত্য ও নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন বিশ্লেষণে বোঝা যায়, এ জনপদ প্রায় ৭০০-৮০০ বছর আগে সভ্যতার আলোয় আলোকিত হয়।
মহারাজা কন্দর্প নারায়ণের কন্যা বিদ্যাসুন্দরী ও কমলা রানীর দিঘি-সংক্রান্ত কাহিনিগুলো ভোলার লোকজ সংস্কৃতির অংশ হিসেবে আজও প্রচলিত। এই দিঘির কাহিনিকে কেন্দ্র করে দূর তামিলনাড়ুর নিম্নাঞ্চলেও গান পরিবেশিত হয়।
১৯২০ সালে এবং পুনরায় ১৯৭২ সালে ভোলায় পৌরসভা গঠন করা হলে, ভোলা শহর পৌরশহরের মর্যাদা অর্জন করে এবং নগরায়নের পথে আরও এক ধাপ অগ্রসর হয়।