বরিশাল জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ জেলা হলো বরিশাল। এর প্রাচীন ইতিহাস, নদীমাতৃক প্রকৃতি ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বরিশালকে একটি বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে।তবে এই জেলার নাম “বরিশাল” কীভাবে উদ্ভূত হলো, তা নিয়ে রয়েছে নানা মত ও জনশ্রুতি। একদিকে যেমনঃ ইতিহাসবিদদের গবেষণায় উঠে এসেছে বিভিন্ন ব্যাখ্যা, অন্যদিকে স্থানীয় জনপদের কাহিনিতেও রয়েছে এর নামকরণের নানা রকম গল্প।
এই আর্টিকেলে আমরা বরিশাল জেলার নামকরণের পেছনের ইতিহাস ও তাৎপর্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যা জেলার সামগ্রিক ইতিহাস অনুধাবনে সহায়ক হবে।
বরিশাল জেলার নামকরণের ইতিহাস?
এক জনপ্রিয় মত অনুযায়ী, অতীতে এ অঞ্চলে প্রচুর বড় বড় শাল গাছ জন্মাত। সেই কারণে ‘শাল’ শব্দকে কেন্দ্র করে এলাকাটির নাম ‘বরিশাল’ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
এই মতটির পক্ষে একটি স্থানীয় প্রবাদও প্রচলিত আছে “আইতে শাল, যাইতে শাল / তার নাম বরিশাল।” এই প্রবাদটি অঞ্চলটির প্রাকৃতিক পরিবেশ ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যকে কেন্দ্র করে নামকরণের ইঙ্গিত দেয়।
আরেকটি প্রচলিত কিংবদন্তি হলো পর্তুগীজ যুগের একটি প্রেমকাহিনীকে ঘিরে। অনেকের মতে, পর্তুগীজ বণিক ‘বেরি’ ও তার প্রেমিকা ‘শেলি’র নাম সংমিশ্রণে ‘বেরি-শেলি’ থেকে ‘বরিশাল’ নামটির উৎপত্তি হয়েছে।
যদিও এটি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত নয়, তথাপি স্থানীয় সংস্কৃতিতে এই গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে। তৃতীয়ত, গিরদে বন্দরের (যা তখন ‘গ্রেট বন্দর’ নামে পরিচিত ছিল) সঙ্গে যুক্ত একটি মত অনুযায়ী,
ঢাকার নবাবদের এ অঞ্চলে লবণের বড় বড় গোলা ও চৌকি ছিল। সেই সময় ইংরেজ ও পর্তুগীজ বণিকরা এসব লবণের চৌকিকে ‘বরিসল্ট’ নামে ডাকত। কেউ কেউ মনে করেন,
বরিশালের লবণের দানাগুলো আকারে বড় হওয়ার কারণেও ‘বরিসল্ট’ শব্দটি ব্যবহার হতো। পরবর্তীতে ধ্বনিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘বরিসল্ট’ শব্দটি বিবর্তিত হয়ে ‘বরিশাল’ নাম ধারণ করে।
এই সব মতভেদ ও কিংবদন্তি থেকে বোঝা যায়, বরিশালের নামকরণ ইতিহাস ও লোকচর্চার মেলবন্ধনের একটি চমৎকার উদাহরণ। ১৭৯৭ সালে ম্যাজিস্ট্রেসি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রেগুলেশন-৭ অনুযায়ী বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলকে একত্র করে বাকেরগঞ্জ জেলা গঠন করা হয়।
তৎকালীন প্রভাবশালী জমিদার আগা বাকের খানের নাম অনুসারে এ জেলার নামকরণ হয় “বাকেরগঞ্জ”। ১৮০১ সালের ১লা মে, তৎকালীন গভর্নর স্যার জন শ্যোর জেলার সদর দপ্তর বর্তমান বরিশাল শহরে স্থানান্তর করেন।
এর পর থেকে জেলা “বরিশাল” নামেই অধিক পরিচিতি লাভ করে। ১৮১৭ সালে বাকেরগঞ্জ জেলা একটি পূর্ণাঙ্গ কালেক্টরেটে পরিণত হয়। ১৮২৯ সালে ঢাকা বিভাগ গঠিত হলে বাকেরগঞ্জ জেলা ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়।
আরও পড়ুনঃ হবিগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস
উল্লেখযোগ্য যে, এই জেলা ছিল ঢাকা বিভাগ গঠনের সময়কার চারটি কালেক্টরেটের একটি। জেলা সদর কলকাতা থেকে প্রায় ১৮০ মাইল পূর্বে অবস্থিত ছিল।
১৮৭২ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার মোট আয়তন ছিল ৪,০৬৬ বর্গমাইল। এ অঞ্চল বর্তমানে মাদারীপুর, বরিশাল, ঝালকাঠী, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলার অন্তর্ভুক্ত এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল।
১৮৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত Calcutta Gazette এ এ জেলার সীমানা সম্পর্কে বলা হয়ঃ “এই জেলার উত্তরে ফরিদপুর, পশ্চিমে ফরিদপুর ও বলেশ্বর নদী যা যশোর জেলা থেকে পৃথক করেছে, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং পূর্বে মেঘনা নদী ও তার মোহনা।”