পড়াশোনা

গাজীপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস

বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত গাজীপুর জেলা ঐতিহাসিকভাবে এক সমৃদ্ধ জনপদ। যার শিকড় ছড়িয়ে রয়েছে হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাসে। প্রাক্-মৌর্য যুগ থেকে শুরু করে মুসলিম শাসনামল

এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগ পর্যন্ত গাজীপুর অঞ্চলের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন ধারায় এসেছে নানা পরিবর্তন। এই জনপদের পরিচিতি প্রাচীন কালে ছিল ‘ভাওয়াল পরগনা’ নামে, যা কালক্রমে ‘গাজীপুর’ নামে রূপান্তরিত হয়।গাজীপুর জেলার নামকরণের ইতিহাসগাজীপুর নামকরণের পেছনে রয়েছে নানা কিংবদন্তি, ইতিহাস এবং জনশ্রুতি। একদিকে কেউ মনে করেন দিল্লির সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের সময়কার গাজী নামের বিখ্যাত কুস্তিগিরের নামানুসারে এই এলাকার নামকরণ হয়,

আবার কেউ মনে করেন সম্রাট আকবরের অন্যতম সেনাপতি ঈশা খাঁর পুত্র ফজল গাজীর নাম থেকেই গাজীপুরের উদ্ভব। ভাওয়াল রাজ্যের প্রাচীন ঐতিহ্য, মুসলিম গাজীশক্তির উত্থান

এবং নবাবী আমলের প্রশাসনিক বিন্যাস সব মিলিয়ে গাজীপুর নামটি আজকের গৌরবময় পরিচয় পেয়েছে। এই ভূমিকা থেকেই গাজীপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস বিশ্লেষণ করা হবে।

গাজীপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস?

গাজীপুর নামের উৎপত্তি সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, দিল্লির সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের শাসনকালে গাজী নামে এক কুস্তিগির এই অঞ্চলে বসবাস করতেন

এবং তার নাম অনুসারেই এলাকাটির নামকরণ করা হয় গাজীপুর। অন্যদিকে, কিছু গবেষকের মতে, মুঘল সম্রাট আকবরের বিখ্যাত সেনাপতি ঈশা খাঁর পুত্র ফজল গাজীর নামানুসারে এ অঞ্চলের নাম রাখা হয়েছে গাজীপুর।

গাজীপুর জেলা ঢাকা জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তীতে গাজীপুর সদর, শ্রীপুর, কালিয়াকৈর, কালিগঞ্জ এবং কাপাসিয়া এই পাঁচটি উপজেলা নিয়ে ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ গাজীপুর জেলা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে।

এক সময়ের প্রাচীন জনপদ ভাওয়াল পরগনা বর্তমানে গাজীপুর জেলা নামে পরিচিত। ভাওয়াল নামকরণের পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক পটভূমি। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায়,

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এই অঞ্চল মগধ সম্রাট অশোকের শাসনাধীন ছিল। এ ধারণার পেছনে মূল ভিত্তি হলো জয়দেবপুরে অবস্থিত সাকাশ্বর স্তম্ভ। প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলের ডবাক, ডাকুরাই,

সাকেশ্বরসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদ পাল, দাস, চেদী ও চন্ডালদের দ্বারা শাসিত হতো। পরবর্তীতে মুসলিম শাসনামলে এসব জনপদ একত্রিত হয়ে ‘ভাওয়াল’ (ভাহওয়াল) নামে একটি সুবৃহৎ পরগনায় রূপান্তরিত হয়।

ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীতে রাজা যশোপাল, শিশুপাল প্রতাপ ও মহেন্দ্র ভাওয়ালের বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র সামন্ত রাজ্য স্থাপন করেন। প্রচলিত কিংবদন্তি মতে, এসব সামন্ত রাজ্য চেদী রাজ্য নামে পরিচিত ছিল।

বর্তমান গাজীপুর জেলার শ্রীপুর, কালিয়াকৈরের আংশিক, কাপাসিয়া, কালীগঞ্জ, টঙ্গী, ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও ও ত্রিশাল উপজেলার অংশবিশেষ, ঢাকা জেলার সাভারের কিছু অংশ,

নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের উত্তরাংশ এবং টঙ্গীর পশ্চিমে হরিরামপুর ইউনিয়ন নিয়ে এসব ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোর বিস্তার ঘটেছিল। ভাওয়াল নামের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মতামত প্রচলিত রয়েছে।

ভাওয়াল গবেষক নুরুল ইসলাম ভাওয়ালরত্নের মতে, চন্ডাল রাজাদের পতনের পর পরে ভাওয়াল গাজীদের অধিকারে আসে। তবে অনেকেই মনে করেন যে, ‘ভদ্রপাল’ কিংবা ‘ভবপাল’ নাম থেকেই ভাওয়াল শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।

মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় ভবপাল নামক এক রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার কেউ কেউ মনে করেন ‘ভগালয়’ শব্দ থেকে ভাওয়াল নামের উদ্ভব, কারণ মহাভারতে ভগালয়ের উল্লেখও রয়েছে।

ব্রহ্মা পুরাণেও ‘ভদ্র’ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। নুরুল ইসলামের মতে, ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে প্রথম ভাওয়াল অঞ্চলের নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক সূত্র মতে, দ্বাদশ শতাব্দীতে সেন বংশের রাজাদের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ার পর মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

এ সময় ভাওয়াল গাজী নামক এক মুসলিম শাসক এখানে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং একে একে চেদী রাজ্যগুলো দখল করে নেন। পরবর্তীতে নিজের নামানুসারে তিনি এ জনপদের নাম রাখেন ‘ভাওয়াল’।

তাঁর প্রকৃত নাম ছিল ‘ভাহওয়াল গাজী’, যা স্থানীয় উচ্চারণে ‘ভাওয়াল গাজী’ রূপে প্রচলিত হয়। নবাবী আমলে ভাওয়াল পরগনার রাজস্ব আদায়ের জন্য ধীরাশ্রম নামে একটি থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ধীরাশ্রমকে ঘিরে গড়ে ওঠে এক সমৃদ্ধ জনপদ,

যার নিদর্শন আজও রাহাপাড়া, তেলীনগর, হয়দ্রাবাদ, রথখোলা, ভারারুল, মেঘডুবি প্রভৃতি গ্রামে ভগ্ন দালান, দিঘি ও প্রাচীন রাস্তাঘাটের চিহ্ন হিসেবে বিদ্যমান।

আরও পড়ুনঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ ভাওয়ালগড় জেলা নামে একটি নতুন প্রশাসনিক বিন্যাসের প্রস্তাবনা করেন।

পরবর্তীতে অন্যান্য নেতারাও ঢাকা সদর উত্তর মহকুমাকে জয়দেবপুরে স্থানান্তর করে ভাওয়ালগড় মহকুমা নামে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান। যদিও পাকিস্তান আমলে এ উদ্যোগ সফল হয়নি।

তবে তখন থেকেই এ অঞ্চল ভাওয়ালগড় জেলা নামে পরিচিতি পেতে থাকে। স্বাধীনতার পরও ভাওয়ালগড়কে জেলা ঘোষণার দাবি অব্যাহত থাকে এবং অবশেষে গাজীপুর জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button