নারায়ণগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলার ইতিহাসে শিল্প, বাণিজ্য ও সাহসী আন্দোলনের এক উজ্জ্বল নাম নারায়ণগঞ্জ। তবে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত প্রাচীন বাংলার মানচিত্রে ‘নারায়ণগঞ্জ’ নামে কোনো শহরের অস্তিত্বের উল্লেখ পাওয়া যায় না।
তখন এই অঞ্চলের প্রধান নগরী ছিল ঐতিহাসিক সোনারগাঁ। যা সুবর্ণগ্রামের উত্তরসূরি হিসেবে মুসলিম আমলে রাজধানী ও বন্দরনগরীর মর্যাদা লাভ করেছিল। পরবর্তী সময়ে মুঘল শাসনামলে ঢাকার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সোনারগাঁয়ের গুরুত্ব কমতে শুরু করে।পলাশী যুদ্ধের (১৭৫৭) পর বাংলার রাজনৈতিক দৃশ্যপট আমূল পরিবর্তিত হয়। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রভাব এ অঞ্চলে ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং শীতলক্ষ্যা নদীর দুই পাড় ঘিরে গড়ে ওঠে নতুন ব্যবসাকেন্দ্র।
এই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এক বিশেষ ঘটনার সূত্রে বর্তমান নারায়ণগঞ্জ এলাকার নতুন নামকরণ ঘটে। পলাশী যুদ্ধে ইংরেজদের সহযোগিতার পুরস্কারস্বরূপ
বাংলা ১১৭৩ সনে (১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে) বিকন লাল পান্ডে ওরফে লক্ষ্মী নারায়ণ ঠাকুর, নবাব মোজাফফর জঙ্গের কাছ থেকে খিজিরপুর এলাকার ভোগস্বত্ব লাভ করেন। তার নামানুসারে খিজিরপুরের নাম পরিবর্তন করে ‘নারায়ণগঞ্জ’ রাখা হয়।
এভাবেই ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে শীতলক্ষ্যার তীরে জন্ম নেয় নতুন এক শহর নারায়ণগঞ্জ, যা ক্রমে বাংলার ইতিহাসে শিল্প ও মুক্তির সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে ওঠে।
নারায়ণগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস?
হিন্দু ধর্মীয় নেতা বিকন লাল পান্ডে, ১৭৬৬ সালে যিনি বেণুর ঠাকুর বা লক্ষী নারায়ণ ঠাকুর নামেও পরিচিত ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট থেকে তিনি এই অঞ্চল অধীনে গ্রহণ করেন।
তিনি প্রভু নারায়ণের সেবার ব্যয় নির্বাহের উদ্দেশ্যে একটি উইলের মাধ্যমে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত একটি বাজার বা মার্কেটকে দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করেন।
এ কারণে পরবর্তীকালে এ স্থানের নামকরণ হয় ‘নারায়ণগঞ্জ’। কালেক্টরেটের প্রারম্ভিক দলিলপত্রে নারায়ণগঞ্জের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত প্রাচীন বাংলার মানচিত্রে “নারায়ণগঞ্জ” নামে কোনো নগরীর অস্তিত্ব ছিল না। সে সময়ে এ অঞ্চলের প্রধান নগরী ছিল সোনারগাঁ, যা প্রাচীন সুবর্ণগ্রামকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল।
মুসলিম আমলে সোনারগাঁ ছিল দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের প্রশাসনিক কেন্দ্র। চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ফিরোজ শাহের অধীনে এটি লখনৌতি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়, ফলে এখানকার হিন্দু শাসনের অবসান ঘটে।
১৩২৪ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দীন তুঘলক বাংলা দখল করে। তিনি সোনারগাঁ, সাতগাঁও ও লখনৌতি এই তিনটি প্রশাসনিক ইউনিটে বিভক্ত করেন। ১৩৩৮ থেকে ১৩৫২ সাল পর্যন্ত সোনারগাঁ ছিল ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের একটি স্বাধীন রাজ্যের রাজধানী।
বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান হিসেবে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ সোনারগাঁয়ের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর পর ১৩৫২ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁ দখল করে এখান থেকে মুদ্রা জারি করেন।
সোনারগাঁর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছাড়াও ফতুল্লা অঞ্চলও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সুফি সাধক শাহ ফতেহউল্লাহ্ বাগদাদ থেকে আসেন ধর্ম প্রচারের জন্য। তার মৃত্যুর পর তার স্মরণে এ এলাকার নামকরণ হয় “ফতুল্লা”।
মুঘল আমলে (১৬১১ সালে) মুসা খানের পতনের পর সোনারগাঁ মুঘল সুবাহ বাংলার একটি সরকারে পরিণত হয়। তবে ১৬১০ সালে ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণার ফলে সোনারগাঁয়ের গুরুত্ব দ্রুত কমে আসে।
এরপর ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে পানাম নগর গড়ে ওঠে, যার স্থাপত্য নিদর্শন আজও ঐতিহাসিক সাক্ষী বহন করে। মুঘল আমলের পূর্ব থেকেই খিজিরপুর, কদমরসুল ও মদনগঞ্জ আন্তর্জাতিক নদীবন্দর হিসেবে বিখ্যাত ছিল।
পলাশীর যুদ্ধের (১৭৫৭) পর ইংরেজরা এ অঞ্চলে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসে। পাট, লবণ ও মসলার জন্য এই অঞ্চল বিশ্বজুড়ে পরিচিতি লাভ করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনে শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড়ের গুরুত্ব বাড়ে,
যেখানে সুন্দর যোগাযোগব্যবস্থা এবং নদীপথের সুবিধার কারণে একের পর এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।মুঘল আমলে এই নদীবন্দর থেকে রাজস্ব আদায় হতো ৬,৪৪৭ টাকা ১০ আনা ৯ পয়সা।
কোম্পানি আমলে ১৮৫০ সালে এখান থেকে প্রায় ৩ কোটি গজ চট রপ্তানি হতো ইউরোপ ও আমেরিকায়। ১০০ গজ চটের মূল্য ছিল ৭ টাকা। বাংলা সন ১১৭৩ সালে (১৭৬৬ খ্রিষ্টাব্দে) বিখন লাল ঠাকুর ওরফে লক্ষ্মী নারায়ণ ঠাকুর
কোম্পানির নবাব মোজাফফর জঙ্গের কাছ থেকে খিজিরপুর অঞ্চলের ভোগস্বত্ব লাভ করেন। তার নামে উৎসর্গিত হয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এই অঞ্চলের নাম পরিবর্তিত হয়ে “নারায়ণগঞ্জ” হয়।
শীতলক্ষ্যা নদী, যাকে বিশ্বের দ্বিতীয় শান্ত নদী ‘হারবার’ বলা হয় (টেমস নদীর পরে), নারায়ণগঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এক সময় ইংল্যান্ডের ওষুধ কোম্পানিগুলো এই নদীর পানি ব্যবহার করত।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৭৬ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ের ৪.৫ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা প্রতিষ্ঠা করে। প্রথম পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মি. এইচটি উইলসন।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-সোনারগাঁ অঞ্চলে ১৮৬৬ সালে ডাক যোগাযোগ চালু হয় এবং ১৮৭৭ সালে ইংরেজরা ব্যক্তিগত টেলিফোন সার্ভিস শুরু করে। ১৮৮০ সালে নারায়ণগঞ্জ নৌবন্দরকে ফ্রিপোর্ট ঘোষণা করা হয়।
এর ফলে নদীপথে কলকাতা, আসাম ও চট্টগ্রামের সঙ্গে নৌ-পরিবহন চালু হয়। এরপর ১৮৮৫ সালে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলসেবা চালু হলে নারায়ণগঞ্জ বিশ্ববাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়।
ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের অবদান
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জবাসী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছাত্রনেতা শামসুজ্জোহা, বজলুর রহমান, বদরুজ্জামান, মফিজ উদ্দিন, হাবিব রশিদ, সুলতান মাহমুদ মোল্লিক, কাজী মজিবুর,
শেখ মিজান ও এনায়েত নগরের শামসুল হক প্রমুখ ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। আজও ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরীতে অংশ নিয়ে তারা সেই স্মৃতি চারণ করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল।
আরও পড়ুনঃ মৌলভীবাজার জেলার নামকরণের ইতিহাস
সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এম.এ. গনি, মোহাম্মদ আলী, মোঃ নাসির উদ্দিন, মহিউদ্দিন রতন, নুরুল ইসলাম, মোঃ সামসুল হক, মমিনুল ইসলাম ও হাবিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ডালডার মিল এলাকায় পাক সেনারা দখলদারিত্ব চালাত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে বুড়িগঙ্গা নদীতে হত্যা করে ফেলে দিত। মুক্তিযোদ্ধা দুলাল ও আমিনুর ডিক্রিরচর ও কানাই নগরে মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী সংগঠিত করেন। বাবুরাইলের শরিফুল আশরাফ সম্মুখসমরে বীরত্বের পরিচয় দেন।