মানিকগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা হলো মানিকগঞ্জ। এই জেলার নামকরণের পেছনে রয়েছে বহু প্রাচীন কাহিনি, কিংবদন্তি ও ঐতিহাসভিত্তিক তথ্য।
একদিকে যেমনঃ নদী-নালায় বেষ্টিত ভূখণ্ড, অন্যদিকে এখানকার মানুষদের জীবন ও সংস্কৃতি মিশে আছে শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে। ‘মানিকগঞ্জ’ নামটি কীভাবে উদ্ভূত হলো তা নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে।কেউ কেউ মনে করেন, দুর্ধর্ষ পাঠান সরদার মানিক ঢালীর নামানুসারেই মানিকগঞ্জ জেলার নামকরণ করা হয়েছে। আবার অন্য একটি মত অনুযায়ী, এক সময়ে এখানে ‘মানিক’ নামে বিখ্যাত এক জমিদারের আধিপত্য ছিল,
তার নামানুসারে এলাকাটির নামকরণ হয়। ইতিহাসের ধারা ও স্থানীয় জনশ্রুতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই জেলার নামকরণ প্রক্রিয়া ছিল একটি সময়োপযোগী ও সাংস্কৃতিক ঘটনার প্রতিফলন।
আজকের আর্টিকেলে মানিকগঞ্জ জেলার নামের উৎস, ইতিহাস এবং সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
মানিকগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস?
“মানিকগঞ্জ” নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায় সংস্কৃত এবং ফারসি শব্দের সংমিশ্রণ থেকে। “মানিক” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “মানিক্য” শব্দ থেকে, যার অর্থ হচ্ছে চুনি বা পদ্মরাগ (এক ধরনের মূল্যবান রত্ন)।
অপরদিকে, “গঞ্জ” শব্দটি ফারসি ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ বাজার বা জনপদ। মানিকগঞ্জ নামে কোনো গ্রাম বা মৌজার অস্তিত্ব পুরনো কোনো ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না।
১৮৪৫ সালে মহকুমা প্রতিষ্ঠার পূর্বে কোনো ঐতিহাসিক দলিল বা সরকারী নথিতে মানিকগঞ্জের নামের উল্লেখ নেই। তবে নামের উৎপত্তি নিয়ে তিনটি প্রধান জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছেঃ
১. সুফি দরবেশ মানিক শাহ-এর জনশ্রুতি
অনেকের মতে, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে সুফি দরবেশ মানিক শাহ সিংগাইর উপজেলার মানিকনগর গ্রামে আসেন। তিনি এখানে খানকা প্রতিষ্ঠা করে ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করেন।
পরে তিনি হরিরামপুর উপজেলার দরবেশ হায়দার শেখের মাজারে যান এবং অবশেষে ইছামতি নদীর তীরবর্তী এক জনশূন্য চরাঞ্চলে আবারও খানকা স্থাপন করেন। মানিক শাহের এই খানকাকে ঘিরেই পরবর্তী সময়ে জনবসতি গড়ে ওঠে।
পরবর্তীতে তিনি ধলেশ্বরী নদীর তীরে চলে আসেন এবং সেখানেও একটি খানকা স্থাপন করেন। তার অলৌকিক গুণাবলীর জন্য সকল ধর্মের মানুষ তাকে সম্মান করত। এমনকি দস্যু ও তস্কররাও তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল
এবং খানকার আশপাশে কোনো অশুভ কার্যকলাপে লিপ্ত হতো না। ফলে বণিকরাও এখানে নিরাপদে বিশ্রাম এবং রাত্রিযাপন করত। এভাবেই মানিক শাহের স্মৃতিকে কেন্দ্র করে ধলেশ্বরীর তীরে নতুন জনপদ ও মোকাম গড়ে ওঠে।
২. পাঠান সরদার মানিক ঢালীর জনশ্রুতি
কেউ কেউ মনে করেন, দুর্ধর্ষ পাঠান সরদার মানিক ঢালীর নামানুসারেই মানিকগঞ্জ নামের উৎপত্তি হয়েছে। তার প্রভাব ও প্রাধান্য এলাকায় এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, তার নাম থেকেই এই অঞ্চলের নামকরণ হয়।
৩. তেঁওতা জমিদার বাড়ির সূত্র
তেঁওতা জমিদার বাড়ির ইতিহাসেও মানিকগঞ্জ নামের উত্থান ও বিকাশের কিছু ছাপ পাওয়া যায়। জমিদার বাড়ির আশেপাশের এলাকা ও তাদের প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে এই নামটির প্রচার ও প্রতিষ্ঠা আরও বিস্তৃত হয়।
বাংলার মধ্য-ভাটি অঞ্চলভুক্ত মানিকগঞ্জ জেলা নদীবাহিত পলিমাটি দ্বারা গঠিত এক উর্বর ভূমি। বিশেষ করে পদ্মা, যমুনা, কালীগঙ্গা, ধলেশ্বরী, ইছামতি, করতোয়া,
তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদী যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলের ভূমি গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। এসব নদী বিভিন্ন সময় বন্যা ও পলি জমার মাধ্যমে মানিকগঞ্জের ভূমিকে আরও উর্বর ও বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে।
গাজীখালি, ধলেশ্বরী ও কালীগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর শহর মানিকগঞ্জ। নদী ও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে ঘেরা এ জেলার নৈসর্গিক দৃশ্য প্রকৃতিপ্রেমীদের মুগ্ধ করে।
আরও পড়ুনঃ পিরোজপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস
প্রশাসনিক ইতিহাস
মানিকগঞ্জ মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪৫ সালের মে মাসে। প্রথমদিকে এটি ফরিদপুর জেলার (১৮১১ সালে প্রতিষ্ঠিত) অধীনে ছিল।
পরবর্তীতে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ১৮৫৬ সালে মানিকগঞ্জ মহকুমাকে ফরিদপুর জেলা থেকে পৃথক করে ঢাকা জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।