পড়াশোনা

কুষ্টিয়া জেলার নামকরণের ইতিহাস

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল কুষ্টিয়া জেলা, যা ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যচর্চার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। এই জেলার নামকরণ এবং এর পেছনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কেবল নামমাত্র নয়।

বরং এটি বহন করে একটি সমৃদ্ধ অতীতের পরিচায়ক। কুষ্টিয়ার নামকরণের সঙ্গে স্থানীয় ভূ-প্রকৃতি, জনপদের বিকাশ, প্রশাসনিক রূপান্তর এবং জনগণের সাংস্কৃতিক চেতনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।কুষ্টিয়া জেলার নামকরণের ইতিহাসবাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বিশেষত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহের বাসস্থান এবং বাউল সম্রাট লালন শাহের জন্মভূমি হিসেবে কুষ্টিয়া আজও সাহিত্য-সংস্কৃতির বাতিঘর।

এই জেলার নামকরণ কিভাবে হলো এবং এর পেছনের ঐতিহাসিক উপাদানগুলো বিশ্লেষণ করা হলে কুষ্টিয়ার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়।

এই আর্টিকেলে কুষ্টিয়া জেলার নামের উৎপত্তি ও ঐতিহাসিক পটভূমি বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার নামকরণের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরার প্রয়াস করা হবে।

কুষ্টিয়া জেলার নামকরণের ইতিহাস?

কুষ্টিয়া বহু আগ থেকেই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে স্বীকৃত। তবে “কুষ্টিয়া” নামটির উৎস নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এ নামের উৎপত্তি সম্পর্কে কয়েকটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়,

যার মধ্যে হেমিলটনস গেজেট (১৮২০ প্রকাশিত) ভিত্তিক মতটি সবচেয়ে সমর্থিত। এই মতে, কুষ্টিয়া অঞ্চলে এক সময় বিপুল পরিমাণে পাট উৎপন্ন হতো। স্থানীয় ভাষায় পাটকে ‘কোষ্টা’ বা ‘কুষ্টি’ বলা হতো, যেখান থেকে “কুষ্টিয়া” নামটি উদ্ভূত হয়েছে।

আজও অনেক স্থানে পাটকে ‘কোষ্টা’ বলা হয়। আরেকটি মতে, ফার্সি শব্দ ‘কুশতহ’ (অর্থঃ ছাই দ্বীপ) থেকে কুষ্টিয়া নামটি এসেছে। ধারণা করা হয়, কোনো সময়ে এই অঞ্চলে অগ্নিকাণ্ড বা ভস্মীভূত কিছু ঘটনার স্মৃতি থেকে এমন নামকরণ হয়ে থাকতে পারে।

তৃতীয় আরেকটি মত অনুযায়ী, ৫ম মুঘল সম্রাট শাহ জাহানের সময়ে কুষ্টি বন্দরের বিকাশের মধ্য দিয়ে কুষ্টিয়া শহরের সূচনা ঘটে। এই বন্দরকে ঘিরেই ধীরে ধীরে জনবসতি গড়ে ওঠে এবং শহরের রূপ নেয়।

এইভাবে বিভিন্ন ইতিহাস নির্ভর মতের ভিত্তিতে কুষ্টিয়া নামটির উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। কুষ্টিয়ার প্রশাসনিক ইতিহাস একটি দীর্ঘ ও ধাপে ধাপে পরিবর্তিত ধারার প্রতিফলন।

১৭২৫ সালে কুষ্টিয়া অঞ্চল নাটোর জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সময়ে কুষ্টিয়ার পরিচিতি আসে কান্ডানগর পরগণার মাধ্যমে, যা রাজশাহী ফৌজদারীর সিভিল প্রশাসনের অধীনে ছিল।

পরবর্তীতে ১৭৭৬ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কুষ্টিয়াকে যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত করে। তবে ১৮২৮ সালে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের ফলে কুষ্টিয়া পাবনা জেলার আওতাভুক্ত হয়।

আরও পড়ুনঃ ঝালকাঠি জেলার নামকরণের ইতিহাস

১৮৬১ সালে নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে কুষ্টিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় এবং একটি পৃথক মহকুমা হিসেবে কুষ্টিয়া মহকুমা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৮৭১ সালে কুমারখালী ও খোকসা থানাকে অন্তর্ভুক্ত করে কুষ্টিয়া মহকুমাকে নদীয়া জেলার অংশ করা হয়।

ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের আগে, কুষ্টিয়া নদীয়া জেলার অধীন একটি মহকুমা ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর কুষ্টিয়া একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সেই সময় কুষ্টিয়া জেলা তিনটি মহকুমা নিয়ে গঠিত হয়েছিলঃ কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা এবং মেহেরপুর।

পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর পৃথক জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে কুষ্টিয়া মহকুমার ৬টি থানা নিয়ে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা গঠিত হয়, যা আজও বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button