মেহেরপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন জনপদ মেহেরপুর। ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক দিক থেকে এই জেলার গুরুত্ব সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান।জেলার নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন জনশ্রুতি, ঐতিহাসিক অনুমান ও গবেষণার তথ্য থাকলেও সুনির্দিষ্ট কোনো দলিল পাওয়া যায় না। তবে প্রাচীন সভ্যতা, ধর্মীয় সংস্কার
এবং বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর প্রভাবের ভিত্তিতে মেহেরপুর নামের উৎপত্তি সম্পর্কিত নানা মতামত গড়ে উঠেছে। এই অধ্যায়ে মেহেরপুর নামের উৎস সন্ধানের প্রচেষ্টাই তুলে ধরা হয়েছে।
মেহেরপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস?
মেহেরপুর নামকরণ বিষয়ে ইতিহাসবিদ ও জনশ্রুতিতে দুটি সম্ভাব্য তথ্য পাওয়া যায়। যদিও এই দুটি তথ্য অনুমানভিত্তিক, তবে ইতিহাস ও লোকমুখে প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এগুলোর মধ্যে গুরুত্ব রয়েছে।
১. আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব দরবেশ মেহের আলী শাহ-এর নামানুসারে
মেহেরপুর নামকরণের একটি প্রধান ধারণা হলো, ষোড়শ শতক বা তার কিছু পরবর্তীকালে ইসলাম প্রচারক দরবেশ মেহের আলী শাহ এর নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নামকরণ করা হয়।
ইতিহাসের পাতায় দেখা যায়, মুসলিম শাসনের সূচনা থেকেই দক্ষিণ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচার শুরু হয়। খ্যাতিমান সুফি সাধক হযরত খান জাহান আলী (রহ.) গৌড় অঞ্চল থেকে ভৈরব নদীপথে মেহেরপুর হয়ে বারোবাজার অতিক্রম করে বাগেরহাটে পৌঁছান।
তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে ছিলেন ৩৬০ জন দরবেশ ও ৬০ হাজার সৈন্য। এই ধারাবাহিকতায় মেহেরপুর অঞ্চলেও ইসলামের পতাকা উত্তোলিত হয় এবং এখানে কয়েকজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটে। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন শাহ ভালাই, শাহ আলাই এবং এনায়েত উল্লাহ।
এঁদের একজন ছিলেন দরবেশ মেহের আলী শাহ, যিনি তাঁর আধ্যাত্মিক প্রভাব ও সামাজিক অবদানের কারণে অত্যন্ত খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। তাঁর নামের মাহাত্ম্যে এই অঞ্চল “মেহেরপুর” নামে পরিচিতি লাভ করে বলে অনেকের বিশ্বাস।
২. প্রাচীন জ্যোতির্বিদ মিহির ও খনার নামানুসারে
মেহেরপুর নামকরণের আরেকটি প্রচলিত ধারণা হলো, এটি প্রাচীন জ্যোতির্বিদ মিহির ও তাঁর পুত্রবধূ খনা-এর নাম থেকে উদ্ভূত। “খনার বচন” নামে বাংলায় খ্যাতিমান ভবিষ্যদ্বাণিমূলক বাক্যসমূহের রচয়িতা খনার পিতা বা শ্বশুর হিসেবে মিহিরের নাম পাওয়া যায়।
ধারণা করা হয়, তারা ভৈরব নদীর তীরবর্তী এ অঞ্চলে বসবাস করতেন। সেই সূত্রে এলাকাটির নাম প্রথমে “মিহিরপুর” ছিল এবং সময়ের সাথে সাথে অপভ্রংশ হয়ে তা “মেহেরপুর” রূপ লাভ করে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত মেহেরপুর জেলা এক প্রাচীন জনপদ হিসেবে পরিচিত। প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চল নানা ঐতিহাসিক পরিবর্তন, শাসনব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক প্রভাবে গঠিত হয়েছে।
যদিও মেহেরপুরের উৎপত্তির নির্দিষ্ট সময় জানা যায় না, তবে জনশ্রুতি ও ভৌগলিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর প্রাচীনতার ইঙ্গিত মেলে।
নামকরণের ইতিহাস
মেহেরপুর নামের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কারো মতে এটি রাজা বিক্রমাদিত্যের সময় গঠিত জনপদ, আবার কুমুদনাথ মল্লিকের মতে, “মিহিরখনার” নাম থেকেই “মিহিরপুর”, পরে “মেহেরপুর” হয়েছে।
অন্যদিকে ড. আশরাফ সিদ্দিকীর মতে, ১৬শ শতকের দরবেশ মেহের আলী শাহের নামানুসারে এ নামকরণ হয়েছে। তবে এসব মতানুমান ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত নয়।
প্রাচীন ইতিহাস
২য় শতাব্দীতে টলেমির মানচিত্রে গঙ্গা অববাহিকায় যে ক্ষুদ্র দ্বীপসমূহের উল্লেখ আছে, তা বর্তমান কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
অনুমান করা হয়, দক্ষিণ বঙ্গ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে কৃষি ও মাছ আহরণের উদ্দেশ্যে মানুষ এখানে বসতি স্থাপন করে। ৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত মেহেরপুর অঞ্চল কোনো শক্তিশালী রাজ্যের অধীনে ছিল না বলে ধারণা করা হয়।
সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাঙ্কের শাসনকালে এই অঞ্চল তার রাজ্যের অন্তর্গত ছিল বলে অনুমান করা হয়। পরবর্তীতে শশাঙ্কের মৃত্যুর পর এই অঞ্চল কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
পাল ও সেন শাসন
৮ম শতকের দিকে পাল বংশের শাসন প্রতিষ্ঠার পর মেহেরপুর পাল রাজ্যের অংশ হয় এবং ১০ম শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এই শাসন বহাল থাকে। লক্ষণ সেনের শাসনকাল পর্যন্ত মেহেরপুর ছিল হিন্দু শাসকদের নিয়ন্ত্রণে।
১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী নদীয়া দখলের মাধ্যমে মুসলিম শাসনের সূচনা করেন, যদিও তখন তা তেমন স্থায়ী ছিল না। পরবর্তীতে মুর্গিস উদ্দীন উজবুক আবারও নদীয়া দখল করে মুসলিম শাসনের ভিত্তি দৃঢ় করেন।
সুলতানি ও মোগল আমলে মেহেরপুর
১৩৮৯ থেকে ১৪০৯ সাল পর্যন্ত গৌড়ের রাজা গিয়াসউদ্দীন আযম শাহের সময় রাজা কংস বা গণেশ গৌড় দখল করে স্বাধীন শাসন কায়েম করেন।
তাঁর পুত্র যদু মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে জালালউদ্দীন নাম ধারণ করেন এবং শাসন চালান। তাঁর পুত্র শামসউদ্দীন আহমদ শাহের সময় ইসলাম ধর্ম প্রচারে মেহেরপুরে আউলিয়া ও দরবেশগণের আগমন ঘটে।
আরও পড়ুনঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস
নদীয়া রাজবংশ ও মেহেরপুর
মোগল সম্রাট আকবরের আমলে বাগোয়ানের ভবানন্দ মজুমদার নদীয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উত্তরসূরিরা নদীয়া তথা মেহেরপুর শাসন করেন।
রাজা রাঘব রায় ও তাঁর পুত্র মহারাজা রুদ্র কৃষ্ণের নামানুসারে নদীয়ার একাংশের নামকরণ করেন কৃষ্ণনগর। ১৭১০ সালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নদীয়ার সিংহাসনে আরোহণ করেন।
এবং দীর্ঘকাল মেহেরপুর অঞ্চল তাঁর শাসনাধীন ছিল। নবাব আলীবর্দী খান তাকে গ্রেফতারও করেন, কারণ তিনি খাজনা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন।
কোম্পানি শাসন ও আধুনিক যুগ
১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর মেহেরপুর কোম্পানির শাসনে চলে যায়। নীল বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে ১৮০৩ সালে গাংনী থানা যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। মেহেরপুরের এই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক রূপান্তর নতুন যুগের সূচনা করে।
শেষ কথা
মেহেরপুরের ইতিহাস শুধুমাত্র একটি জেলার ইতিহাস নয়। এটি বৃহত্তর বঙ্গভূমির রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জীবন্ত দলিল।
প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ, সুলতানি ও মোগল আমল পেরিয়ে ঔপনিবেশিক শাসন পর্যন্ত মেহেরপুরের বিবর্তন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।