সাতক্ষীরা জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত সাতক্ষীরা জেলা, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে অনন্য এক জনপদ। বঙ্গোপসাগরের উপকূলঘেঁষা এই জেলা যেমনঃ সুন্দরবনের নিবিড় ছায়ায় মোড়া,
তেমনি এর অতীতেও লুকিয়ে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতিচ্ছবি। সাতক্ষীরা নামটির উৎপত্তি নিয়ে প্রচলিত আছে নানা জনশ্রুতি ও ঐতিহাসিক মতামত। নামটি শুধুই একটি ভৌগোলিক নির্দেশক নয়।বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্থানীয় ইতিহাস, মানুষের বসতি, ব্রাহ্মণ সংস্কৃতি এবং বৃটিশ শাসনামলের প্রশাসনিক পটপরিবর্তনের চিহ্ন। এই জেলার নামকরণে যেমন উঠে আসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ইতিহাস,
তেমনি শোনা যায় লোককথা ও ধর্মীয় আখ্যানে ঘেরা গল্প। অতীতের সেই সাতঘরিয়া থেকে বর্তমানের সাতক্ষীরা হয়ে ওঠার ইতিহাস একদিকে যেমনঃ মননশীল, তেমনি এটি একটি জনপদের আত্মপরিচয়ের ধারক ও বাহক।
সাতক্ষীরা জেলার নামকরণের ইতিহাস?
প্রাচীনকালে বর্তমানে সাতক্ষীরা নামে পরিচিত এই অঞ্চল বিভিন্ন নামে অভিহিত হতো। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এ অঞ্চলকে বাগড়ী, ব্যাঘ্রতট, সমতট, যশোর এবং বুড়ন প্রভৃতি নামে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এসব নামের পেছনে ছিল ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, রাজনৈতিক প্রশাসনিক বিন্যাস এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের প্রভাব। তবে ‘সাতক্ষীরা’ নামটির উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে নানা মতামত। এর মধ্যে দুটি মত সর্বাধিক প্রচলিত ও আলোচিত।
প্রথম এবং প্রধান মতামত অনুযায়ী, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের একজন কর্মচারী বিষুরাম চক্রবর্তী নিলামে বুড়ন পরগনা ক্রয় করেন এবং এর অন্তর্গত সাতঘরিয়া নামক গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।
পরবর্তীতে তাঁর পুত্র প্রাণনাথ চক্রবর্তী ওই এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। ১৮৬১ সালে ইংরেজ শাসকগণ মহকুমা স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে, তাঁরা প্রশাসনিক কার্যালয় স্থাপনের জন্য পরিচিত এলাকা সাতঘরিয়াকেই নির্বাচন করেন।
সময়ের প্রবাহে এবং ইংরেজ উচ্চারণে ‘সাতঘরিয়া’ রূপান্তরিত হয়ে ‘সাতক্ষীরা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। দ্বিতীয় একটি লোককথানির্ভর মত অনুসারে, একসময় সাত জন মনীষী সাগর ভ্রমণ শেষে এ অঞ্চলে এসে কিছুদিন অবস্থান করেন।
একপর্যায়ে রান্নার উপকরণ সংকটের কারণে তাঁরা শুধুমাত্র ক্ষীর রান্না করে আহার করেন। এই ঘটনার স্মৃতিবশত স্থানীয় লোকজন স্থানটির নাম দেন ‘সাতক্ষীরা’, যেখানে ‘সাত’ মানে সাতজন মনীষী এবং ‘ক্ষীরা’ এসেছে ‘ক্ষীর’ শব্দ থেকে।
সময়ের সঙ্গে এটি রূপান্তরিত হয়ে সাতক্ষীরা নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত সাতক্ষীরা জেলা, যা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ও ভারতীয় সীমান্তের নিকটে অবস্থিত।
আজকের জনপদ এককালে ছিল বিস্তীর্ণ জলাভূমি ও বনাঞ্চল। সময়ের আবর্তে এখানে গড়ে ওঠে মানব বসতি এবং ধীরে ধীরে গড়ে উঠে একটি সমৃদ্ধ জনপদ।
প্রাচীন ইতিহাসে জানা যায়, সপ্তম শতাব্দীতে ভদ্রবংশীয় মহাসামন্তগণ এ অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। জনশ্রুতি রয়েছে, মহিষাসুরমর্দিনী নাটকের প্রখ্যাত বাচিকশিল্পী বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র এই ভদ্রবংশেরই উত্তরসূরি ছিলেন।
সাতক্ষীরা জেলার আদি নাম ছিল সাতঘরিয়া। ধারণা করা হয়, ১৭৭২ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এক কর্মচারী বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী ‘বুড়ন পরগনা’ নামক এলাকা নিলামে ক্রয় করে সাতঘরিয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।
তাঁর পুত্র প্রাণনাথ চক্রবর্তী এখানে সাতঘর কুলীন ব্রাহ্মণ এনে বসবাসের ব্যবস্থা করেন, ফলে এলাকার নাম হয় সাতঘরিয়া। পরবর্তীতে ইংরেজ শাসকদের উচ্চারণভেদে নামটি রূপান্তরিত হয়ে ‘সাতক্ষীরা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
ইতিহাসের পাতায় সাতক্ষীরা একসময় যশোর, ফরিদপুর, খুলনা ও সাতক্ষীরা নিয়ে গঠিত বৃহত্তর জেলার অংশ ছিল। উল্লেখযোগ্যভাবে, এই জনপদ বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্যর যশোহর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তাঁর রাজধানী ছিল সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ ও শ্যামনগর এলাকায়। রাজা প্রতাপাদিত্যের পর, এ অঞ্চলে ব্যাপক প্রশাসনিক উন্নয়ন সাধিত হয় ইংরেজ কর্মকর্তা টিলম্যান হেংকেলের নেতৃত্বে।
১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি যশোর অঞ্চলে প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট ও জজ হিসেবে নিযুক্ত হন এবং একই বছর যশোরে প্রথম আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৮৬ সালে তিনি খুঁটি স্থাপন করে এলাকার সীমানা চিহ্নিত করেন, যা স্থানীয় প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল।
আরও পড়ুনঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস
প্রশাসনিকভাবে সাতক্ষীরা অঞ্চল প্রথমে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে মহকুমার মর্যাদা লাভ করে এবং এটিকে নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে নদীয়া থেকে আলাদা করে চব্বিশ পরগণা জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৮৮২ সালে খুলনা জেলা গঠিত হলে সাতক্ষীরা সেখানে একটি মহকুমা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এই পরিবর্তনসমূহে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড রিপনের (১৮৮০-৮৪) প্রশাসনিক উদারতাই ছিল অন্যতম কারণ।
দেশের প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের আওতায় সাতক্ষীরা মহকুমাকে একটি পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে সাতক্ষীরা জেলা গঠিত হয়েছে ৭টি উপজেলা, ৯৬০টি মৌজা, ১৪২১টি গ্রাম, ৮টি থানা, ৭৮টি ইউনিয়ন এবং ৩টি পৌরসভা নিয়ে।