পড়াশোনা

মুন্সীগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস

বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ জেলা হলো মুন্সীগঞ্জ। রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী হওয়ার কারণে জেলা হিসেবে এর ভৌগোলিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।মুন্সীগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাসপ্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলে নানা সভ্যতা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে, যার প্রতিফলন পাওয়া যায় এ জেলার নামকরণেও। মুন্সীগঞ্জ নামটি ইতিহাস ও জনশ্রুতির এক গভীর প্রেক্ষাপটে গঠিত।

যা সময়ের পরিক্রমায় একটি ঐতিহাসিক পরিচয়ে পরিণত হয়েছে। এই জেলার নামকরণ কেবল একটি স্থানীয় পরিচিতির বহিঃপ্রকাশ নয়। বরং এর পেছনে রয়েছে প্রশাসনিক ধারা, সামাজিক অবস্থা ও ধর্মীয় প্রভাবের এক আন্তঃসম্পর্কিত ইতিহাস।

মুন্সীগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস?

মুন্সীগঞ্জ জেলার নামকরণ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে ভিন্নমত রয়েছে। মোঘল শাসনামলে এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল ‘ইদ্রাকপুর’। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এখানে ইদ্রাকপুর কেল্লা নির্মাণ করা হয়,

যার তৎকালীন ফৌজদারের নাম ছিল ইদ্রাক। ধারণা করা হয়, তাঁর নামানুসারেই অঞ্চলটির নাম হয় ‘ইদ্রাকপুর’।পরে ব্রিটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হলে ইদ্রাকপুর রামপাল পরগনার অংশ হয়ে পড়ে।

সে সময় রামপালের কাজী কসবা গ্রামের মুন্সী এনায়েত আলী এই এলাকাটি জমিদারভুক্ত করেন। অনেকে মনে করেন, তাঁর ‘মুন্সী’ পদবির সূত্র ধরেই ‘ইদ্রাকপুর’ নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘মুন্সীগঞ্জ’ নামে পরিচিতি পায়।

আবার আরেকটি মতামত অনুযায়ী, মোঘল শাসনামলে এখানে নিযুক্ত ফৌজদারী আদালতের প্রধান ছিলেন হায়দার আলী মুন্সী। তাঁর প্রভাব ও খ্যাতির কারণে এলাকাটি পরবর্তীতে ‘মুন্সীগঞ্জ’ নামে পরিচিত হয়।

এইসব ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও, ইতিহাসের পাতা থেকে ধারণা করা যায় যে, ‘ইদ্রাকপুর’ নামটি মুন্সীগঞ্জে রূপান্তরিত হওয়ার পেছনে ‘মুন্সী’ পদবিধারী কোন একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির অবদান ছিল অনস্বীকার্য।

প্রাচীনকালে মুন্সীগঞ্জ নিঃসন্দেহে বঙ্গভূমির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টীয় দশম শতকের শুরু থেকে ত্রয়োদশ শতকের প্রথমাংশ পর্যন্ত এই অঞ্চলটি চন্দ্র,

বর্মন ও সেন রাজবংশের রাজধানী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুন্সীগঞ্জের প্রাচীন নাম বিক্রমপুর ছিল, এবং এই নামের উল্লেখ সর্বপ্রথম দেখা যায় শ্রীচন্দ্রের তাম্রশাসনে, যেখানে বলা হয়েছে:

“স খলু শ্রী বিক্রমপুর সমাবাসিত শ্রীমজ্জয়স্কন্ধবারাত” অর্থাৎ, রাজকীয় রাজধানীস্থান হিসেবে বিক্রমপুরে (বর্তমান মুন্সীগঞ্জ) অবস্থানরত জয়স্কন্ধের কথা। এই মর্যাদা পরবর্তী বর্মন ও সেন রাজাদের আমলেও অব্যাহত ছিল।

সেন বংশের শাসনামলে, যারা প্রায় সমগ্র বঙ্গদেশে প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন, মুন্সীগঞ্জ তাদের রাজধানী হিসেবে বিদ্যমান ছিল। যখন মুসলিম সেনানায়ক বখতিয়ার খলজী নদীয়ায় আক্রমণ চালিয়ে লক্ষ্মণসেনকে পরাজিত করেন,

তখন লক্ষ্মণসেন বিক্রমপুরে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁর দুই পুত্র বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেনও অল্প সময়ের জন্য এ অঞ্চল শাসন করেন। যদিও তাদের তাম্রশাসনে রাজধানী হিসেবে বিক্রমপুরের নাম উল্লেখ নেই,

তথাপি তারা যে ভূমি দান করেছিলেন, তা বর্তমান মুন্সীগঞ্জ অঞ্চলেই অবস্থিত ছিল, যা তাদের এখানকার কর্তৃত্বের প্রমাণ বহন করে। মুন্সীগঞ্জের রাজনৈতিক খ্যাতি ১২৮০ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিক পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।

এরপর দনুজমাধব দশরথদেব অথবা জিয়াউদ্দীন বরনীর বর্ণিত দনুজ রায় তাঁর রাজধানী বিক্রমপুর থেকে স্থানান্তর করে সুবর্ণগ্রাম (বর্তমান সোনারগাঁও)-এর নিকটবর্তী অঞ্চলে স্থাপন করেন।

এর ফলে সুলতানি আমলে মুন্সীগঞ্জ ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যায়। পুনরায় মোঘল আমলে, মুন্সীগঞ্জের নাম রাজস্ব নথিতে পরগনা হিসেবে উল্লেখিত হতে শুরু করে।

আরও পড়ুনঃ চুয়াডাঙ্গা জেলার নামকরণের ইতিহাস

এই সময়ে বাংলার বারো ভূঁইয়াদের অন্তর্ভুক্ত চাঁদ রায় ও কেদার রায় মোঘলদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বীরোচিত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাঁদের এই প্রতিরোধ মুন্সীগঞ্জকে সাময়িক হলেও নতুন করে গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত করে।

এইভাবে ইতিহাসের নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে মুন্সীগঞ্জ একসময় বঙ্গরাজ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে যেমন উজ্জ্বল ছিল, তেমনি পরবর্তীকালে রাজনৈতিক বিবর্তনের ফলে এক সময় বিস্মৃতির গর্ভেও তলিয়ে যায়। তবে তার গৌরবোজ্জ্বল অতীত আজও ইতিহাসে স্মরণীয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button