পড়াশোনা

পটুয়াখালী জেলার নামকরণের ইতিহাস

বাংলাদেশের উপকূলবর্তী একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর জেলা পটুয়াখালী। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা এই জেলার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য একদিকে যেমনঃ অনন্য,

তেমনি এর নামকরণ নিয়েও রয়েছে নানা কাহিনি, বিশ্বাস ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ। ইতিহাসবিদদের মতে, পটুয়াখালী নামটি শুধু একটি প্রশাসনিক পরিচয়ের প্রতীক নয়।পটুয়াখালী জেলার নামকরণের ইতিহাসবরং এটি বহন করে উপকূলবাসীর সংগ্রাম, জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য, নৌপথকেন্দ্রিক জনপদের উত্থান এবং ভাষাগত বিবর্তনের এক দীর্ঘ ইতিহাস। পটুয়াখালী নামকরণের উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়,

লোকমুখে প্রচলিত নানা উপকথা থেকে শুরু করে ইতিহাসবিদদের গবেষণা পর্যন্ত এতে যুক্ত হয়েছে। এই আর্টিকেলে পটুয়াখালীর নামকরণের নানামুখী দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত বিশ্লেষণ করে একটি প্রামাণ্য চিত্র উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে।

পটুয়াখালী জেলার নামকরণের ইতিহাস?

পটুয়াখালী নামের উৎপত্তি নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিভিন্ন মত প্রচলিত রয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম ও ব্যাপকভাবে সমর্থিত মত প্রদান করেছেন প্রখ্যাত প্রবন্ধকার ও বরিশালের ইতিহাস-গ্রন্থের লেখক সিরাজ উদ্দিন আহমেদ।

তাঁর মতে, স্থানীয় জনগণের ভাষায় ‘নটুয়া’ নামে পরিচিত একদল পর্তুগিজ জলদস্যু পটুয়াখালী শহরের উত্তরে অবস্থিত ভরণী খাল দিয়ে এসে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতো।

এই জলদস্যুদের খাল হিসেবে পরিচিতি পায় ‘নটুয়ার খাল’। কালক্রমে ভাষাগত রূপান্তরের মাধ্যমে ‘নটুয়ার খাল’ ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে ‘পটুয়ার খাল’ নামে পরিচিত হতে থাকে। এখান থেকেই এলাকাটির নাম ‘পটুয়াখালী’ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

এই মতবাদের সমর্থনে ১৯৮০ সালে শেরেবাংলা টাউন হল, পটুয়াখালীতে অনুষ্ঠিত “পটুয়াখালী জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য” শীর্ষক এক সেমিনারে অধিকাংশ বক্তা সিরাজ উদ্দিন আহমেদের অভিমতকে যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করেন।

অন্য একটি জনপ্রিয় মত হলো, পটুয়াখালী নামটি এসেছে কবি দেবেন্দ্রনাথ দত্ত রচিত বিখ্যাত কবিতা ‘পতুয়ার খাল’ থেকে। যদিও এটি সাহিত্যনির্ভর অভিমত, তবে অনেকেই মনে করেন কবিতাটির জনপ্রিয়তার প্রেক্ষিতে অঞ্চলটির নামকরণে এর প্রভাব থাকতে পারে।

এছাড়াও আরও দুটি মত প্রচলিত রয়েছে। প্রথমটি অনুযায়ী, এই অঞ্চলে একসময় ‘পটুয়া’ নামে পরিচিত এক সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল যারা মাটির পাত্রে নানা ধরনের পটচিত্র অংকন করতো। তাদের নামানুসারে অঞ্চলটির নাম ‘পটুয়াখালী’ হয়ে থাকতে পারে।

অন্যদিকে, আরেকটি মতে, এলাকাটি চারপাশে পেট-আকৃতির খাল দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় এর নাম হতে পারে ‘পেটুয়াখালী’, যা পরবর্তীতে ধ্বনিগত পরিবর্তনে ‘পটুয়াখালী’ হয়েছে। তবে এই দুটি মতের পক্ষে কোনো শক্ত প্রমাণ বা ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।

এইভাবে সংকলিত বিবরণ থেকে বোঝা যায়, ‘নটুয়া জলদস্যুদের’ খাল থেকে ‘পটুয়াখালী’ নামের উৎপত্তির তত্ত্বটি সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য ও দলিলভিত্তিক। অন্যান্য মতগুলো আঞ্চলিক লোককথা ও সাহিত্যিক অনুষঙ্গের ওপর নির্ভরশীল হলেও

ইতিহাসের প্রামাণ্য আলোচনায় সেগুলোর ভিত্তি তুলনামূলকভাবে দুর্বল। পটুয়াখালী জেলা ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক সময় এটি প্রাচীন রাজত্ব চন্দ্রদ্বীপের অন্তর্ভুক্ত ছিল,

যার রাজধানী ছিল বর্তমান বাউফল উপজেলার কচুয়া অঞ্চলে। তবে প্রকৃতির নিষ্ঠুর বিপর্যয় এবং ঘন ঘন পর্তুগীজ ও মগ জলদস্যুদের আক্রমণের ফলে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে বরিশালের মাধবপাশায় গড়ে ওঠে।

১৬শ শতকের শেষভাগে, মুঘল সম্রাট আকবরের বিখ্যাত অর্থমন্ত্রী রাজা টোডরমল ১৫৯৯ সালে কানুনগা জিম্মক খানকে এই অঞ্চল জরিপ করার নির্দেশ দেন। জরিপের মাধ্যমে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের ঘন বনাঞ্চল থেকে

আলাদা করে একটি সুরক্ষিত এলাকা হিসেবে বাজুহাদবা অঞ্চলকে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে এই এলাকাকে সেলিমাবাদ, বাজুগ উমেদপুর ও উরানপুর নামক তিনটি পরগনায় ভাগ করে প্রশাসনিক কাঠামো গঠিত হয়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে, বার্মার (মিয়ানমার) রাজাদের দমন-নিপীড়ন থেকে বাঁচতে আরাকান অঞ্চল থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন জনগোষ্ঠী পলায়ন করে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পটুয়াখালী জেলার উপকূলীয় অঞ্চলসমূহে আশ্রয় নেয়।

তারা বিশেষ করে গলাচিপা, কলাপাড়ার কুয়াকাটা ও খেপুপাড়া এবং রাঙ্গাবালীর দ্বীপাঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। এই রাখাইন জনগোষ্ঠীর আগমনের পর থেকে এ অঞ্চলে মানুষের বসবাস ও জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধে পটুয়াখালী

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও পটুয়াখালী জেলাকে পেছনে রাখা যায় না। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতেই, ২৬ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে পাক হানাদার বাহিনী পটুয়াখালী শহরে প্রথম আক্রমণ চালায়।

সেদিন শহরের মাতবরবাড়ি, পুরান বাজার এবং ডিসি বাসভবনের আশপাশের এলাকায় ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয়। শতাধিক নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে হানাদার বাহিনী।

আরও পড়ুনঃ জামালপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পটুয়াখালীর সদর, গলাচিপা, কলাপাড়া সহ বিভিন্ন উপজেলায় একাধিক খণ্ড যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এইসব যুদ্ধে বহু স্বাধীনতাকামী সূর্য সন্তান শহীদ হন, যাঁদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা।

দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে, ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ পটুয়াখালী জেলা হানাদার মুক্ত হয়। এই দিনটি জেলার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button