রাজশাহী জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলার ইতিহাসে রাজশাহী একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। যার নামের উৎপত্তি ঘিরে রয়েছে নানা মতভেদ ও ঐতিহাসিক বিতর্ক। ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে রাজশাহীর গুরুত্ব যেমনঃ প্রাচীনকাল থেকেই ছিল।
তেমনি এর নামকরণ সম্পর্কেও সময়ের সঙ্গে গড়ে উঠেছে নানা কাহিনি ও অনুমান। “মহাকাল গড়” থেকে “রামপুর বোয়ালিয়া” এবং পরবর্তীতে “রাজশাহী” এই নামান্তরের পেছনে রয়েছে রাজা জমিদার, নবাব ও উপনিবেশিক প্রশাসনের ভূমিকা।রাজা গণেশ, নবাব মুর্শিদকুলী খান, নাটোরের রামজীবন ও রাণী ভবানীর মতো ঐতিহাসিক চরিত্রদের কার্যক্রম ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজশাহী নামের বিকাশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব রেখেছে বলে ধারণা করা হয়।
এই আর্টিকেলে আমরা ঐতিহাসিক দলিল, মতামত ও ঘটনার আলোকে রাজশাহী নামটির উৎস সন্ধানে প্রচেষ্টা করব।
রাজশাহী জেলার নামকরণের ইতিহাস?
রাজশাহী জেলার নামকরণ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে ব্যাপক মতো পার্থক্য রয়েছে। এই অঞ্চলের নাম “রাজশাহী” কীভাবে হলো, তা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক, অনুমান ও কল্পকাহিনী প্রচলিত রয়েছে।
তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার কেন্দ্রে রয়েছে নবাবী আমল ও নাটোরের রাজপরিবারের প্রভাব। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় মনে করেন, “রাজশাহী” নামটির প্রবর্তক ছিলেন রাণী ভবানী।
অপরদিকে, মি. গ্রান্ট উল্লেখ করেন যে, রাণী ভবানীর জমিদারীকেই “রাজশাহী” নামে অভিহিত করা হতো এবং এই নামটির উল্লেখ পাওয়া যায় চাকলার বন্দোবস্ত সংক্রান্ত নথিপত্রে।
ঐতিহাসিক দলিল অনুযায়ী, রাজশাহী চাকলা নামে এক বৃহৎ প্রশাসনিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়, যার পরিধি ছিল পদ্মার উত্তরাঞ্চল থেকে শুরু করে পাবনা পেরিয়ে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত।
এমনকি নদীয়া, যশোর, বর্ধমান ও বীরভূম পর্যন্ত এই প্রশাসনিক এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। অর্থাৎ “রাজশাহী চাকলা” নামে পরিচিত অঞ্চলটি ছিল এক বিশাল ভৌগোলিক এলাকা, যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বর্তমান রাজশাহী অঞ্চল।
ধারণা করা হয়, “রামপুর” ও “বোয়ালিয়া” নামক দুটি গ্রামের সংযুক্তির ফলে রাজশাহী শহরের সূচনা ঘটে। প্রথমদিকে এই জনপদ ‘রামপুর-বোয়ালিয়া’ নামে পরিচিত ছিল,
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘রাজশাহী’ নামটি জনপ্রিয়তা পায় এবং সাধারণ জনগণের ব্যবহারে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান রাজশাহী শহরের বিকাশ মূলত ১৮২৫ সাল থেকে শুরু হয়।
এর আগে রাজশাহী জেলার সদরদপ্তর ছিল নাটোর শহর এলাকায়। পরবর্তীতে নারদ নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে ব্রিটিশ প্রশাসন পদ্মানদীর তীরে অবস্থিত রামপুর-বোয়ালিয়াকে রাজশাহীর সদর ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে।
ভাষাগত দিক থেকে বিচার করলে “রাজশাহী” নামটি দুটি ভিন্ন ভাষার সমার্থক শব্দের সংমিশ্রণ। ‘রাজ’ (সংস্কৃত) এবং ‘শাহী’ (ফারসি ‘শাহ’ থেকে আগত) উভয়েই রাজা বা শাসনের অর্থবোধক।
বাংলা ভাষায় একই অর্থ প্রকাশকারী দুটি শব্দ একত্রে ব্যবহারের চল রয়েছে যেমন: শাক-সবজি, শিক্ষা-দীক্ষা, ভুল-ভ্রান্তি ইত্যাদি। তাই অনেকেই মনে করেন, “রাজশাহী” শব্দের গঠনও বাংলা ভাষার এই দ্বিত্ব শব্দপ্রয়োগ রীতির একটি উদাহরণ।
অন্য একটি মত অনুযায়ী, রাজশাহী নামের উৎপত্তি হয় রাজা গণেশের শাসনামলে (১৪১৪–১৪১৮)। তবে এই মতের ঐতিহাসিক ভিত্তি দুর্বল, কারণ সে সময়ের রাজস্ব দলিল বা প্রশাসনিক নথিতে “রাজশাহী” নামের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না।
পরবর্তীকালে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের অংশ হিসেবে, ১৯৮৪ সালে বৃহত্তর রাজশাহী জেলার চারটি মহকুমা আলাদা করে চারটি স্বতন্ত্র জেলায় উন্নীত করা হয় রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর এবং নবাবগঞ্জ। পরবর্তীতে নবাবগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ রাখা হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ের ইতিহাস ও মতভেদ
ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্নে প্রাপ্ত নথিপত্রে “রাজশাহী” নামক কোনো শহর বা জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায় না। অনেকের মতে, এই জনপদে একসময় হিন্দু-মুসলিম রাজা, সুলতান ও জমিদারদের আধিপত্য ছিল বলেই একে “রাজশাহী” নামে অভিহিত করা হয়।
এখানে “রাজ” অর্থ রাজা এবং “শাহী” অর্থ শাসন বা সালতানাত। ঐতিহাসিক ব্লকম্যান (Bolchmann) মনে করেন, খ্রিস্টীয় ১৫শ শতকে গৌড়ের মুসলিম সালতানাত যুগে ভাতুড়িয়ার জমিদার রাজা গণেশ এই অঞ্চলের দখল নেন।
এবং তখন থেকেই রাজা (রাজ) ও শাহী (সুলতানী প্রভাব) শব্দ দুটি মিলে “রাজশাহী” নামটির উদ্ভব ঘটে। তবে ব্লকম্যানের এই মতের বিরোধিতা করেন ঐতিহাসিক বেভারিজ (Beveridge)।
তিনি উল্লেখ করেন, রাজা গণেশের সময় যদি এই নামের উৎপত্তি ঘটত, তবে তা টোডরমলের রাজস্ব তালিকা বা আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী-তে উল্লেখ থাকত। কিন্তু সেখানে “রাজশাহী” নামে কোনো অঞ্চল বা প্রশাসনিক ইউনিটের উল্লেখ নেই।
নাটোরের রাজপরিবার ও নবাবী আমলের প্রভাব
ঐতিহাসিক ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার মনে করেন, নাটোরের রাজা রামজীবনের জমিদারী-কেই ব্রিটিশরা “রাজশাহী” নামে অভিহিত করে। যদিও এ ব্যাখ্যা অনেকের কাছে ইতিহাস হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়, তবে এটি বেশ আলোচিত একটি মত।
বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খান ১৭০০ থেকে ১৭২৫ সালের মধ্যে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে পুরো বাংলাকে ১৩টি চাকলায় ভাগ করেন। এর মধ্যে একটি বিস্তৃত অঞ্চল ছিল “চারুলা রাজশাহী”, যার মধ্যে বর্তমান রাজশাহীসহ পদ্মা বিধৌত বিস্তীর্ণ এলাকা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই “চাকলা রাজশাহী” নামকরণ নিয়েও রয়েছে মতভেদ। অনেকে মনে করেন, মুর্শিদকুলী খানের প্রিয় হিন্দু রাজা ও জমিদার উদয় নারায়ণ-এর নামেই এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় “রাজশাহী”।
১৭১৪ সালে নবাব মুর্শিদকুলী খান নাটোরের রামজীবন নামক জমিদারের হাতে রাজশাহী চাকলা বন্দোবস্ত দেন। এই জমিদারী পরবর্তীতে রাণী ভবানীর হাতে আসে। রামজীবনের মৃত্যুর পর তার দত্তক পুত্র রামকান্ত রাজা হন।
১৭৫১ সালে রামকান্তের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ভবানী দেবী “রাণী ভবানী” নামে জমিদারীর দায়িত্ব নেন। তাঁর শাসনামলে এই জমিদারী আরও বিস্তৃতি লাভ করে।
আরও পড়ুনঃ ঠাকুরগাঁও জেলার নামকরণের ইতিহাস
চূড়ান্ত মত ও ঐতিহাসিক গ্রহণযোগ্যতা
ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় মনে করেন, রাণী ভবানী-ই “রাজশাহী” নামটির প্রবর্তক। অপরদিকে মি. গ্রান্ট লিখেছেন, রাণী ভবানীর জমিদারীকেই “রাজশাহী” নামে অভিহিত করা হতো, এবং রাজস্ব সংক্রান্ত দলিলেও রাজশাহী নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
শেষ কথা
রাজশাহী নামটির উৎপত্তি নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে নানা মতভেদ থাকলেও এটুকু নির্ভরযোগ্যভাবে বলা যায় যে, নবাবী আমল থেকে শুরু করে নাটোরের রাজপরিবার ও বিশেষত রাণী ভবানীর জমিদারী এই নামের প্রবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এটি নিছক একটি ভূগোলিক নাম নয়, বরং এর পেছনে লুকিয়ে আছে শতাব্দীপ্রাচীন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাস।