নীলফামারী জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এক জনপদের নাম নীলফামারী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, উর্বর মাটি ও ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহে গঠিত এই অঞ্চল আজও ধারণ করে আছে নানান ঐতিহাসিক স্মৃতি ও জনশ্রুতি।
নীলফামারী নামটির উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে একটি চিত্তাকর্ষক ইতিহাস, যার শিকড় নিহিত রয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনামলে বিশেষ করে ইংরেজ শাসকদের দ্বারা পরিচালিত নীল চাষ এবং তাদের স্থাপিত নীল খামারের সাথে।এই অঞ্চলটি ছিল নীল চাষের জন্য উপযোগী ভূমি। ফলে এখানে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য নীলকুঠি ও নীল খামার। স্থানীয়দের মুখে মুখে “নীল খামার” থেকে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে “নীলফামারী” নামটি গড়ে ওঠে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
এই প্রেক্ষাপট থেকেই নীলফামারী জেলার নামকরণ ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে, যা এখনো এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
নীলফামারী জেলার নামকরণের ইতিহাস?
নীলফামারী, হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত একটি প্রাচীন জনপদ, যার ইতিহাস বহু ঘটনার সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ জেলার নামকরণ নিয়ে রয়েছে এক আকর্ষণীয় ইতিহাস।
দুই শতাধিক বছর আগে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজ নীলকরেরা এ অঞ্চলে নীল চাষের খামার স্থাপন করে। উর্বর মাটির কারণে নীল চাষের জন্য এ অঞ্চল ছিল অত্যন্ত উপযোগী।
ফলে দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় নীলফামারীতে গড়ে ওঠে অধিকসংখ্যক নীলকুঠি ও নীল খামার। দুরাকুটি, ডিমলা, কিশোরগঞ্জ, টেঙ্গনমারীসহ বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত হয় নীলকুঠি।
বিশেষত বর্তমান শহরের তিন কিলোমিটার উত্তরে, পুরাতন রেল স্টেশনের নিকটবর্তী এলাকায় ছিল একটি বিশাল নীলকুঠি। ধারণা করা হয়, স্থানীয় কৃষকদের মুখে প্রচলিত ‘নীল খামার’ শব্দটি রূপান্তরিত হয়ে ‘নীলখামারী’তে পরিণত হয়।
আর এই ‘নীলখামারী’-র অপভ্রংশ থেকেই গঠিত হয় বর্তমান জেলার নাম “নীলফামারী”। নীলফামারীর ইতিহাস শুধু নীলচাষেই সীমাবদ্ধ নয়। খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকে খননকৃত বিরাট রাজার দীঘি, যা পরবর্তীতে ‘বিন্নাদীঘি’ নামে পরিচিত হয়, সে সময়ের প্রাচীন জনবসতির সাক্ষ্য বহন করে।
এছাড়াও ধর্মপালের গড়, হরিশচন্দ্রের পাঠ, ভীমের মায়ের চুলা, ময়নামতির দুর্গ প্রভৃতি নিদর্শন এ জেলার সমৃদ্ধ ইতিহাসের প্রমাণ। এ অঞ্চল গঠিত হয়েছে হিমালয় বাহিত করতোয়া, আত্রাই ও তিস্তা নদীর পলিমাটি দ্বারা।
ফলে এখানকার মৃত্তিকা অত্যন্ত উর্বর এবং কৃষিকাজের জন্য উপযোগী। নানা প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে নীলফামারীকে এক উর্বর সমভূমিতে পরিণত করেছে, যাকে বলা হয় পাদদেশীয় পাললিক সমভূমি।
নীলফামারীর ইতিহাসে রয়েছে সংগ্রামের গৌরবগাথা নীল বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে এ জেলার মানুষ সাহসিকতার সঙ্গে অংশগ্রহণ করে।
প্রতিটি আন্দোলনেই নীলফামারীর জনগণ ছিল অগ্রণী ও প্রতিবাদমুখর। প্রায় বিশ লক্ষ মানুষের বসবাস এ জেলায়, যা আজও অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া একটি অঞ্চল হিসেবে পরিচিত।
আরও পড়ুনঃ দিনাজপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস
অসম ভূমি মালিকানা, শিল্পায়নের অভাব, উচ্চ বেকারত্ব এবং কৃষি নির্ভরতা এখানকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অন্তরায়। তবুও এখানকার উর্বর ভূমি, তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে সেচ সুবিধা এবং বিপুল জনশক্তি একে সম্ভাবনাময় অঞ্চলে পরিণত করেছে।
যদি শিক্ষা, শিল্প এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়, তবে নীলফামারী তার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ধরে রেখে ভবিষ্যতে হতে পারে একটি সমৃদ্ধশালী ও আত্মনির্ভরশীল অঞ্চল।