পড়াশোনা

গাইবান্ধা জেলার নামকরণের ইতিহাস

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদ গাইবান্ধা জেলা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নদনদী আর সমৃদ্ধ কৃষিভিত্তিক জীবনধারার পাশাপাশি এই জেলার রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

গাইবান্ধা নামটি কেবল একটি ভৌগোলিক সীমানার নির্দেশক নয়। বরং এর অন্তর্নিহিত রয়েছে একটি জনপদের গঠনের গল্প, মানুষের জীবনযাত্রা, আর প্রাকৃতিক সামাজিক প্রেক্ষাপটের মিশ্রণ।গাইবান্ধা জেলার নামকরণের ইতিহাস‘গাইবান্ধা’ নামটির উৎপত্তি নিয়ে প্রচলিত আছে বিভিন্ন জনশ্রুতি ও মতামত। কারও মতে, গাই (গরু) এবং বান্ধা (আটকে রাখা বা বেঁধে রাখা) এই দুই শব্দের সংমিশ্রণে গঠিত ‘গাইবান্ধা’ নামটি মূলত একটি নিরাপদ গবাদিপশুর খামার বা আশ্রয়স্থলের নির্দেশ করে।

আবার কেউ বলেন, প্রাচীনকালে এ অঞ্চল ছিল নদী, খাল ও জলাভূমিতে পরিপূর্ণ, যেখানে প্রচুর গরু পালন করা হতো এবং সেগুলো বেঁধে রাখার স্থান হিসেবে পরিচিত ছিল এই অঞ্চল। এই আর্টিকেলে আমরা জানতে পারব গাইবান্ধা জেলার নামকরণ কেবল ভাষাগত বিবর্তন নয়।

বরং এটি একটি অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং প্রাকৃতিক ইতিহাসের প্রতিফলন। পরবর্তী অংশে আমরা এই জেলার নামকরণের পেছনের ইতিহাস, লোককথা এবং বাস্তব প্রেক্ষাপট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

গাইবান্ধা জেলার নামকরণের ইতিহাস?

গাইবান্ধা নামটির উৎস সম্পর্কে ইতিহাস ও লোককথার মিশ্রণে গড়ে উঠেছে এক আকর্ষণীয় কিংবদন্তি। কথিত আছে, আজ থেকে প্রায় ৫,২০০ বছর পূর্বে গাইবান্ধা জেলার বর্তমান গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় বিরাট রাজার রাজ্য বিস্তৃত ছিল।

বিরাট রাজা মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যিনি পাণ্ডবদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাঁর ছিল প্রায় ষাট হাজার গাভী। এই বিপুল সংখ্যক গরু রাখার জন্য একটি নিরাপদ স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল, যেখানে গরুগুলোকে বাঁধা হতো।

এই স্থানকেই বলা হতো ‘গাই-বান্ধা’, অর্থাৎ গরু বেঁধে রাখার জায়গা। সময়ের সাথে সাথে ‘গাইবান্ধা’ নামটি গড়ে ওঠে এবং তাই এই অঞ্চলের পরিচিতি হয়ে ওঠে।

পরে দীর্ঘ ইতিহাস পেরিয়ে গাইবান্ধা আধুনিক প্রশাসনিক কাঠামোয় যুক্ত হয়। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট, বুধবার ০২ ফাল্গুন ১৩৯০ বঙ্গাব্দ এবং ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪০৪ হিজরিতে গাইবান্ধা জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

বামনডাঙ্গার জমিদার বাড়ি

১২৫২ সালে নির্মিত এই ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িটি আজ পরিত্যক্ত হলেও এর কাচারিঘর, বসতবাড়ি, কয়েদখানা ও শিব মন্দির গাইবান্ধার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারক। এখানে বসবাস করতেন সূনীতি বালা দেবী, যাঁর নামের কাচারিঘর আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বর্ধনকুঠি

গোবিন্দগঞ্জ উপজেলাধীন বর্ধনকুঠি ছিল এক সময় রাজা-বাদশাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র। ষোড়শ শতাব্দীতে রাজা রামপাল এখানে বাসুদেব মন্দির নির্মাণ করেন। সেই সময় রাজা মানসিংহ বাংলার সুবাদার ছিলেন। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ আমলে এটি জমিদার বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পায়।

রাজাবিরাট প্রসাদ

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত প্রাচীন রাজাবিরাট প্রসাদটি দেব বংশের রাজাদের সঙ্গে যুক্ত। পাল রাজ্যের পত্তনের সময়, অষ্টম শতাব্দীর শেষভাগে (৭৪৩-৮০০ খ্রিঃ), দেব বংশ দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সমতটে রাজত্ব করত।

ইতিহাসবিদদের মতে এই রাজপ্রাসাদটির অস্তিত্ব মহাভারতের বহু পূর্বে থেকেই ছিল, যা এই অঞ্চলের প্রাচীন রাজনৈতিক গুরুত্ব নির্দেশ করে।

নলডাঙ্গার জমিদার বাড়ি

উপমহাদেশের বিখ্যাত নাট্যকার ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তুলসী লাহিড়ীর স্মৃতিবিজড়িত নলডাঙ্গার জমিদার বাড়ি গাইবান্ধার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়।

ভগ্নপ্রায় কষ্টিপাথরের শিব লিঙ্গ, শ্বেত পাথরের বৃষমূর্তি ও নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শনগুলো একে পরিণত করেছে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসেবে।

শাহ্ সুলতান গাজীর মসজিদ, দাড়িয়াপুর

গাইবান্ধার অন্যতম প্রাচীন মসজিদ এটি। মসজিদের শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৩০৮ সালে সৈয়দ ওয়াজেদ আলী এটি সংস্কার করেন।

পরে শাহ্ সুলতান গাজীর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব পায়। প্রতিবছর বৈশাখ মাসে এখানে লোকজ মেলার আয়োজন হয়।

মহিমাগঞ্জ চিনিকল

১৯৫৫ সালে ৯৩ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত রংপুর চিনিকল গাইবান্ধার শিল্প ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে ২০০১ সালে বন্ধ হলেও ২০০৭ সালে পুনরায় চালু হয়। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল হাজারো শ্রমিক ও হাজার হাজার আখচাষীর জীবন-জীবিকা।

শিবরাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয় বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৮৫ সালে এর প্রধান শিক্ষক জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত হন এবং ২০০২ সালে বিদ্যালয়টিও শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি অর্জন করে।

ভরতখালীর কাষ্ঠ মন্দির (কালী মন্দির)

এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক তীর্থস্থান। জনশ্রুতি আছে, যমুনা নদী থেকে ভেসে আসা এক পোড়া কাঠের টুকরোকে কেন্দ্র করে স্বপ্নাদেশে মন্দিরটি নির্মিত হয়।

আজও এই স্থান ঘিরে রয়েছে অলৌকিক বিশ্বাস ও ধর্মীয় আবেগ। প্রতিবছর বৈশাখ মাসে এখানে পাঠাবলী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

আরও পড়ুনঃ পঞ্চগড় জেলার নামকরণের ইতিহাস

ভবানীগঞ্জ পোস্ট অফিস

গাইবান্ধার প্রশাসনিক বিকাশের ইতিহাসে ভবানীগঞ্জ পোস্ট অফিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৭৫৩ সালে থানা ঘোষিত হওয়ার পর ১৯৫৮ সালের ২৭ আগস্ট ভবানীগঞ্জ মহকুমার কার্যক্রম শুরু হয়।

যার ধারাবাহিকতায় এখানকার ডাক ব্যবস্থা আধুনিকতার ছোঁয়া পায়। এই সকল প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন গাইবান্ধা জেলার অতীত ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং সমাজ রাজনীতির ধারাবাহিক বিবর্তনের মূল্যবান স্মারক।

সংরক্ষণের অভাবে অনেক নিদর্শন আজ ধ্বংসের মুখে। তাই এসব স্থাপনার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও গবেষণাভিত্তিক প্রচার প্রসার অত্যন্ত জরুরি তথ্যভিত্তিক ভবিষ্যতের জন্য অতীতের নির্ভরযোগ্য সেতুবন্ধন রচনার স্বার্থে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button