শেরপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে অবস্থিত শেরপুর জেলা একটি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। ব্রহ্মপুত্র নদী বিধৌত এই জনপদ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রাচীন নিদর্শন, আন্দোলন-সংগ্রাম এবং বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ।এই আর্টিকেলে শেরপুর জেলার নামকরণ, প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সামাজিক দিক তুলে ধরা হয়েছে।
শেরপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস?
শেরপুর অঞ্চল প্রাচীনকালে কামরূপা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬ থেকে ১৬০৫) এই এলাকা “দশকাহনিয়া বাজু” নামে পরিচিত ছিল।
সে সময় শেরপুরে পৌঁছাতে ব্রহ্মপুত্র নদ খেয়া নৌকায় পার হতে হতো এবং পারাপারের জন্য দশ কাহন কড়ি (মুদ্রা) নির্ধারিত ছিল। এ কারণেই এলাকাটি “দশকাহনিয়া” নামে পরিচিতি লাভ করে।
সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে ঈসা খানের বংশধর, ভাওয়ালের গাজীরা দশকাহনিয়া অঞ্চল দখল করেন। পরবর্তীতে গাজী বংশের শেষ জমিদার শের আলী গাজীর নামানুসারে এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় “শেরপুর”।
উপনিবেশিক যুগের বিদ্রোহ ও আন্দোলন
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে ওয়ারেন হেস্টিংস থেকে কর্ণওয়ালিস পর্যন্ত সময়কালে শেরপুর ছিল রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়। এই সময় ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ এখানে বিশেষভাবে বিস্তার লাভ করে।
ফকির আন্দোলনের নেতা টিপু শাহ শেরপুর অঞ্চলে সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করেন এবং গরজরিপা এলাকাকে রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন।
পরবর্তীতে খোশ মুহাম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বে কামারের চরে কৃষক আন্দোলনের তিনটি উল্লেখযোগ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। যথাক্রমে ১৯০৬, ১৯১৪ ও ১৯১৭ সালে।
সামাজিক-অর্থনৈতিক বিদ্রোহ
১৮৩৮ থেকে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত শেরপুরে নানকার, টঙ্ক, বাওয়ালী, মহাজনী ও ইজারাদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যাপক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এইসব বিদ্রোহ পরিচালনায় কমিউনিস্টদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
প্রাকৃতিক পরিবর্তন
১৮৯৭ সালে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ পশ্চিম দিকে পরিবর্তিত করে, যা পরে যমুনা নদীর সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। এই ভূমিকম্প অনেক প্রাচীন স্থাপনা ও অবকাঠামোরও মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে।
নামকরণের ইতিহাস
শেরপুর জেলার নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, মুঘল আমলে আফগান নেতা শের আলী গাজীর নামানুসারে এই অঞ্চলের নামকরণ হয় ‘শেরপুর’।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, ‘শের’ অর্থে সিংহ এবং ‘পুর’ অর্থে নগরী এই অর্থে একে ‘সিংহপুরী’ বা ‘বীরদের আবাস’ হিসেবেও বিবেচনা করা যায়।
প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস
শেরপুর অঞ্চল প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানব বসতির উপযুক্ত ছিল বলে ধারণা করা হয়। পাল ও সেন যুগে এই অঞ্চলে হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষণীয় ছিল।
১২শ শতকে মুসলিম বিজয়ের পর ইসলাম ধর্ম এবং মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তার লাভ করে। মধ্যযুগে মসজিদ, মাজার এবং খিলাফতের বিভিন্ন নিদর্শন নির্মিত হয়।
মুঘল ও নবাবি শাসনামল
মুঘল শাসনামলে শেরপুর ছিল একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। শের আলী গাজী এই অঞ্চলে ফৌজদার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন এবং প্রতিরক্ষা ও শাসন ব্যবস্থার উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে নবাবী শাসনামলে রাজস্ব আদায় ও সামরিক ব্যবস্থাপনার কেন্দ্র হয়ে ওঠে শেরপুর।
ব্রিটিশ উপনিবেশ ও প্রশাসনিক উন্নয়ন
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর ব্রিটিশরা এই অঞ্চল দখল করে। ১৮৭৪ সালে শেরপুর মহকুমা হিসেবে ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়।
রেলপথ, ডাকব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পুলিশ প্রশাসনের প্রসার ঘটে এই সময়ে। জমিদারি ব্যবস্থার ফলে কৃষকদের উপর নির্যাতন বেড়ে যায় এবং বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও শেরপুরের ভূমিকা
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর শেরপুর পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শেরপুরের ছাত্র-জনতা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। এরপর ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে শেরপুর এক বিশাল ভূমিকা পালন করে।
মুক্তিযুদ্ধে শেরপুর
১৯৭১ সালে শেরপুর ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং রাজাকার বাহিনী এই অঞ্চলে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। চণ্ডিপুর, পাকুরিয়া, গজনী, শ্রীবরদীসহ বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা সংঘটিত হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে শেরপুর হানাদারমুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী উন্নয়ন ও প্রশাসনিক বিকাশ
১৯৮৪ সালে শেরপুর জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন ময়মনসিংহ বিভাগের অংশ হলেও পরবর্তীতে এটি জামালপুর থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
বর্তমানে শেরপুরে ৫টি উপজেলা, ৪টি পৌরসভা এবং ৫২টি ইউনিয়ন রয়েছে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অবকাঠামো খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান
শেরপুরে বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা রয়েছে, যেমনঃ শেরপুর জামে মসজিদ, গজনী দরবার শরীফ, গঙ্গাধর একাডেমি মন্দির ইত্যাদি।
পহেলা বৈশাখ, নবান্ন উৎসব, বৈশাখী মেলা, গজনী মেলা প্রভৃতি এই অঞ্চলের সংস্কৃতিকে বর্ণাঢ্য করেছে। লোকসংগীত, পালাগান এবং যাত্রাপালা শেরপুরের সাংস্কৃতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
শিক্ষা ও সামাজিক আন্দোলন
শেরপুরে ব্রিটিশ আমল থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। শেরপুর সরকারী কলেজ, সরকারি মহিলা কলেজ, কারিগরি ও কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি নারী শিক্ষা, শিশুশিক্ষা ও নিরক্ষরতা দূরীকরণে বিভিন্ন আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে।
আরও পড়ুনঃ ঠাকুরগাঁও জেলার নামকরণের ইতিহাস
খেলাধুলা ও যুবসমাজ
শেরপুরে ফুটবল, ক্রিকেট, কাবাডি এবং হাডুডু জনপ্রিয় খেলা। শেরপুর স্টেডিয়াম, উপজেলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সসহ আধুনিক ক্রীড়া অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। ক্রীড়া সংগঠনগুলোর মাধ্যমে যুবসমাজকে মাদক ও অসামাজিক কার্যক্রম থেকে দূরে রাখা হচ্ছে।
শেষ কথা
শেরপুর জেলা শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক অঞ্চল নয়, বরং একটি জীবন্ত ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারক। প্রাচীন নিদর্শন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, কৃষি ও শিক্ষার অগ্রগতি এবং সাংস্কৃতিক চেতনার সংমিশ্রণে শেরপুর আজ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা।
সঠিক পরিকল্পনা ও সংরক্ষণের মাধ্যমে এই জেলার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রক্ষা করা সম্ভব।