সুনামগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস
প্রাচীনকাল থেকে বহু ভাষাভাষী, জাতি, বর্ণ ও ধর্মের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করে এসেছে বর্তমান সুনামগঞ্জ অঞ্চলে, যা বর্তমানে সিলেট বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা।এর প্রাচীন ইতিহাস, পৌরাণিক সংযোগ, স্থানীয় রাজ্যব্যবস্থা এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারের এক গভীর ঐতিহ্য রয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস?
সুনামগঞ্জ জেলার নামকরণের পেছনে একটি জনপ্রিয় জনশ্রুতি রয়েছে, যা ইতিহাসের সঙ্গে মিল রেখে বিবৃত হয়। জানা যায়, ‘সুনামদি’ নামে একজন মোগল সিপাহীর নামানুসারে এই জেলার নামকরণ করা হয়।
‘সুনামদি’ নামটি আসলে ‘সুনাম উদ্দিন’ এর স্থানীয় সিলেটি উচ্চারণ। ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, সুনামদি নামক উক্ত মোগল সৈন্য কোন এক যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
তার বীরোচিত কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্রাট তাকে সুনামগঞ্জ অঞ্চলে কিছু ভূমি পুরস্কার স্বরূপ প্রদান করেন।সুনামদি এই পুরস্কারস্বরূপ প্রাপ্ত জমিতে একটি বাজার স্থাপন করেন,
যা ধীরে ধীরে ‘সুনামগঞ্জ বাজার’ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে এই বাজার কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে একটি জনপদ, যা তার নাম অনুসারেই ‘সুনামগঞ্জ’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এইভাবেই সুনামগঞ্জ নামের উৎপত্তি ও ঐতিহাসিক ভিত্তি গড়ে ওঠে বলে ধারণা করা হয়।
পৌরাণিক ও প্রাচীন ইতিহাস
সুনামগঞ্জ অঞ্চল প্রাচীন কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ অঞ্চলের লাউড় পর্বতে কামরূপ রাজ্যের একটি উপরাজধানী স্থাপন করেছিলেন রাজা ভগদত্ত।
তাঁর শাসনামলে বর্তমান সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা, এমনকি ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলার অংশবিশেষ লাউড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঐতিহাসিক লাউড়ের গড়ের ভগ্নাবশেষ আজও বিদ্যমান, যা রাজা ভগদত্তের রাজবাড়ির নিদর্শন হিসেবে পরিচিত।
লাউড় রাজ্যের সীমানা ছিল পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র নদ, পূর্বে জৈন্তিয়া, উত্তরে কামরূপ সীমান্ত এবং দক্ষিণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। হাওলি নামক স্থানটি রাজবাড়ী ছিল বলে বিশ্বাস করা হয়।
রাজা ভগদত্তের ১৯ জন বংশধর পরবর্তীতে সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে লাউড় রাজ্য কামরূপ রাজ্য থেকে আলাদা হয় এবং দশম শতক থেকে স্বাধীনভাবে শাসিত হতে থাকে।
মধ্যযুগ: লাউড় ও জগন্নাথপুর রাজ্যের বিকাশ
দ্বাদশ শতকে রাজা বিজয় মাণিক্য লাউড় রাজ্য শাসন করেন এবং জগন্নাথপুরে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বল্লাল সেনের অত্যাচারে বিতাড়িত ব্রাহ্মণরা এখানে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
রাজা বিজয় মাণিক্যের পর শাসকদের নাম অনিশ্চিত হলেও চৌদ্দশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কাত্যায়ন গোত্রের দিব্য সিংহ লাউড়ের শাসনভার গ্রহণ করেন এবং রাজধানী নবগ্রামে স্থানান্তর করেন।
এই সময় রাজ্য ছিল জ্ঞানচর্চায় উজ্জ্বল। রাজমন্ত্রী কুবেরাচার্যের খ্যাতি নবদ্বীপ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। সাধু মাধবেন্দ্রপুরীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন রাজপুত্র রমানাথ সিংহ এবং মন্ত্রীপুত্র অদ্বৈত্যাচার্য, যিনি পরে কৃষ্ণদাস নামে খ্যাত হন।
রমানাথ সিংহ রাজ্যভার নিয়ে রাজত্ব করেন এবং তার পুত্রদের মধ্যে এক পুত্রকে লাউড়ে এবং অপর পুত্র কেশবকে সঙ্গে নিয়ে জগন্নাথপুরে বসতি স্থাপন করেন।
মুঘল আগমন ও লাউড়ের পতন
১৬শ শতকের দিকে রাজা গোবিন্দ সিংহ ও জগন্নাথপুরের রাজা বিজয় সিংহের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, যার ফলে বিজয় সিংহ গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন। এ সময় বানিয়াচং রাজ্যের গোবিন্দ খাঁ ইসলাম গ্রহণ করে হাবিব খাঁ নামে পরিচিত হন।
তাঁর প্রভাবে লাউড় রাজ্য স্বাধীনতা হারায় এবং মুঘলদের অধীনস্থ হয়। সুনাম উদ্দিন নামক একজন মুঘল সিপাহী এ অঞ্চলে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে সুনামগঞ্জ নামে পরিচিতি লাভ করে। মূলত বনগাঁও নামেই এলাকাটি আগে পরিচিত ছিল।
আধুনিক প্রশাসনিক বিকাশ
১৮৭৭ সালে সুনামগঞ্জ মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৪ সালে এটি জেলা হিসেবে উন্নীত হয়। বর্তমানে জেলাটিতে ৮১টি ইউনিয়ন এবং ২৭৭৩টি গ্রাম রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস
শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ
সুনামগঞ্জ জেলার শিক্ষার বিকাশে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়ঃ
- সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ সদর (১৮৮৭)
- কৃষ্ণ চন্দ্র পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়, রাজানগর, দিরাই (১৯০৩)
- দিরাই উচ্চ বিদ্যালয়, দিরাই (১৯১৫)
- ব্রজনাথ উচ্চ বিদ্যালয়, পাইলগাঁও, জগন্নাথপুর (১৯১৯)
- সরকারি সতীশ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৪০)
- সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ (১৯৪৪)
- সৈয়দপুর এম ই মাদরাসা, বর্তমানে সৈয়দিয়া শামছিয়া ফাজিল মাদরাসা (১৯০৩)
শেষ কথা
সুনামগঞ্জ জেলার ইতিহাস প্রাচীন লাউড় রাজ্য থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় সাংস্কৃতিক উত্থান, মুঘল প্রভাব এবং আধুনিক শিক্ষা ও প্রশাসনিক কাঠামোর বিকাশের মাধ্যমে এক অনন্য ধারা তৈরি করেছে।
এই জেলার অতীত প্রমাণ করে যে এটি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নয়। বরং ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকেও সমৃদ্ধ।