পড়াশোনা

নাটোর জেলার নামকরণের ইতিহাস

বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার নামের পেছনে রয়েছে একটি স্বতন্ত্র ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পটভূমি। নাটোর জেলা, যা দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত, তার নামকরণেও রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও কৌতূহলোদ্দীপক প্রেক্ষাপট।নাটোর জেলার নামকরণের ইতিহাসনাটোর এক সময় ছিল রাজা-জমিদারদের প্রভাবশালী কেন্দ্র এবং প্রাচীনকালে এটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এই জেলার নাম কীভাবে “নাটোর” হলো তার ইতিহাস,

লোককথা এবং প্রাচীন নথিপত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা সম্ভব। এই আর্টিকেলে আমরা নাটোর জেলার নামকরণের প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

নাটোর জেলার নামকরণের ইতিহাস?

নাটোর জেলার নামকরণ নিয়ে জনশ্রুতি, লোককথা ও ইতিহাসবিদদের বিভিন্ন অভিমত বিদ্যমান। এসব মত ও তথ্য থেকে বোঝা যায়, “নাটোর” নামটির পেছনে রয়েছে একটি বহুমাত্রিক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট।

একটি জনপ্রিয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, এক সময় এই অঞ্চলের কোনো এক স্থানে একটি ব্যাঙ একটি সাপকে গ্রাস করেছিল। এই বিরল দৃশ্য দেখে আশপাশের কয়েকজন বালিকা আনন্দে নৃত্য করতে শুরু করে।

সেই নৃত্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এলাকাটির নামকরণ করা হয় “নাট্যপুর” অর্থাৎ নৃত্যের স্থান। পরবর্তীকালে শব্দটি রূপান্তরিত হয়ে “নাট্যপুর” থেকে “নাটাপুর”, তারপর “নাট্টর” এবং সর্বশেষে “নাটোর” নামটি গঠিত হয়।

আরেকটি প্রচলিত মত হলো, নাটোর জেলার বর্তমান সদর এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান অতীতে এতটাই নিচু ছিল যে সেখানে স্বাভাবিকভাবে চলাচল করা ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। তখন এই স্থানকে বলা হতো “নাতর”

যেখানে “না” অর্থে অসম্ভব এবং “তর” অর্থে গমন বা চলাচল। অর্থাৎ, ‘চলাচল অসম্ভব স্থান’ হিসেবে “নাতর” শব্দটির প্রচলন হয়, যা কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে “নাটোর” নাম ধারণ করে। এছাড়াও একটি ভিন্ন অভিমত অনুযায়ী,

নাটোর শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত নারদ নদীর নাম থেকেই “নাটোর” নামটির উৎপত্তি হয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, নদী-নির্ভর বসতি ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে নদীর নামকে ঘিরে অনেক সময় জনপদের নামকরণ হয়ে থাকে।

এবং নারদ নদী হতে “নাটোর” নামটির উদ্ভবও সেই রীতিরই অংশ হতে পারে। এই সকল ভিন্ন ভিন্ন মত ও কাহিনী থেকে স্পষ্ট যে, নাটোর জেলার নামকরণ শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট উৎস থেকে নয়।

বরং এটি গঠিত হয়েছে দীর্ঘকালীন ভাষাগত রূপান্তর, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সমন্বয়ে। কবির কল্পনায় নাটোর অমর হয়ে আছে কাব্যে। প্রাচীন ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক ঐশ্বর্যে মণ্ডিত বরেন্দ্র ভূমির সন্নিকটে অবস্থিত নাটোর জেলা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা।

২৪.২৬০° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯.৯০° পূর্ব দ্রাঘিমাংশে, নারদ নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত নাটোর শহর ইতিহাস, সংস্কৃতি, ও প্রশাসনিক ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন।

ইতিহাস ও প্রশাসনিক বিকাশ

নাটোর শহরের গোড়াপত্তন ঘটে ১৭১০ সালে রাজা রামজীবন রায়ের মাধ্যমে। তিনি ছাইভাঙা বিল নামক একটি নিচু জলাভূমি ভরাট করে এখানে রাজধানী স্থাপন করেন। পরবর্তীতে এই স্থান প্রাসাদ, দীঘি, উদ্যান ও মন্দিরে সুসজ্জিত নগরিতে পরিণত হয়।

মোগল আমলে নাটোর জেলার গুরতদাসপুর উপজেলার চাপিলা গ্রামে চাপিলা পরগনার কেন্দ্র ছিল। পরে স্বাস্থ্যগত কারণে সদর স্থানান্তরিত হয়ে নাটোরে আসে। ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নাটোর ছিল বৃহত্তর রাজশাহী জেলার সদর।

কিন্তু ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের কারণে জেলা সদর রামপুর বোয়ালিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। ১৮৪৫ সালে নাটোর মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৪ সালে পূর্ণাঙ্গ জেলা রূপে স্বীকৃতি পায়।

নাটোর রাজবংশ ও রাণী ভবানী

নাটোর রাজবংশের গোড়াপত্তন অষ্টাদশ শতকে। রাজা রামজীবন রায় ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। তার পালিত পুত্র রামকান্ত রায়ের সঙ্গে ভবানীর বিবাহ হয়।

রামকান্তের মৃত্যুর পর রাণী ভবানী রাজ্য শাসনের ভার নেন এবং দক্ষতার সঙ্গে জমিদারী পরিচালনা করেন। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে ছিল তার সুসম্পর্ক, এবং পলাশীর যুদ্ধে তিনি নবাবপন্থী ছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে।

দিঘাপতিয়া রাজবংশ ও উত্তরা গণভবন

নাটোরের আরেকটি বিখ্যাত রাজবংশ দিঘাপতিয়া। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দয়ারাম রায়, যিনি কলম গ্রামের এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে রাজা রামজীবনের কর্মচারী থেকে রাজ্যের দেওয়ানে পরিণত হন।

তার পরাক্রম, বুদ্ধিমত্তা ও বিশ্বস্ততার পুরস্কারস্বরূপ রাজা রামজীবন তাকে জমি ও পরগনা দান করেন। দয়ারাম দিঘাপতিয়ায় রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন, যা পরবর্তীতে গভর্নর হাউস ও বর্তমানে ‘উত্তরা গণভবন’ নামে পরিচিত।

রাণী ভবানীর শাসনকাল

জনকল্যাণমূলক কাজ, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং ন্যায়বিচারের জন্য আজও স্মরণীয়।

আরও পড়ুনঃ নীলফামারী জেলার নামকরণের ইতিহাস

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য – কাঁচাগোল্লা

নাটোর জেলার আরেকটি গর্ব কাঁচাগোল্লা মিষ্টান্ন। খাঁটি দুধ থেকে তৈরি এই মিষ্টি স্বাদে অতুলনীয়। জানা যায়, প্রায় আড়াইশো বছর আগে লালবাজারের এক মিষ্টির দোকানদার মধুসূদন

একদিন ছানা নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করতে চিনির রসে ছানা জ্বাল দিয়ে তৈরি করেন কাঁচাগোল্লা। এই আকস্মিক উদ্ভাবন আজ নাটোরের অন্যতম স্বাদগ্রাহী ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।

শেষ কথা

নাটোর জেলা শুধু একটি প্রশাসনিক অঞ্চল নয়। বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি, রাজশক্তি, জনহিতৈষী নেতৃত্ব ও খাদ্য ঐতিহ্যের এক বিশাল ভান্ডার।

রাণী ভবানীর মতো নারীর শাসন, দিঘাপতিয়ার মতো সমৃদ্ধ রাজবংশ এবং কাঁচাগোল্লার মতো লোকজ ঐতিহ্য নাটোরকে করে তুলেছে অতুলনীয়। নাটোরের এই গৌরবময় ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় এবং গবেষণার এক সমৃদ্ধ ক্ষেত্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button