পড়াশোনা

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস

চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা। পদ্মা নদীর তীরবর্তী এই অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যা বিভিন্ন সভ্যতা, ধর্ম এবং সংস্কৃতির মিলনস্থল ছিল।চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাসযার ইতিহাস প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ, ঔপনিবেশিক শাসন, পাকিস্তানি শাসন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করেছে। এই আর্টিকেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নামকরণের উৎপত্তি,

প্রাচীন জনপদ গঠনের প্রমাণ, ঐতিহাসিক নিদর্শন, রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং আধুনিক কালের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস?

চাঁপাইনবাবগঞ্জ নামটি তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিককালের। দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চল “নবাবগঞ্জ” নামে পরিচিত ছিল। তবে দেশের বিভিন্ন জেলায় একাধিক “নবাবগঞ্জ” নাম থাকায় বিভ্রান্তি এড়াতে ও জেলাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে

২০০১ সালের ১ লা আগস্ট সরকারিভাবে জেলার নাম পরিবর্তন করে “চাঁপাইনবাবগঞ্জ” রাখা হয়। নামকরণ সম্পর্কিত নানা মত ও লোককথা রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে, প্রাক-ব্রিটিশ আমলে এই অঞ্চল মুর্শিদাবাদের নবাবদের বিহারভূমি ছিল

এবং বর্তমান সদর উপজেলার দাউদপুর মৌজায় তারা শিকার ও বিশ্রামের জন্য আসতেন। নবাবরা তাঁদের পরিষদ ও অনুসারীদের নিয়ে এখানে অবস্থান করতেন বলেই এ অঞ্চলের নাম “নবাবগঞ্জ” হিসেবে পরিচিতি পায়।

“চাঁপাই” শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে কয়েকটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। লোককথা অনুসারে, নবাব আমলে মহেশপুর গ্রামে চম্পাবতী, যিনি চম্পারানী বা চম্পাবাঈ নামেও পরিচিত ছিলেন, এক খ্যাতনামা বাঈজী বসবাস করতেন।

তাঁর সৌন্দর্য ও নৃত্যকুশলতায় নবাবরা মুগ্ধ হন এবং তিনি নবাবের প্রিয়পাত্রীতে পরিণত হন। ধারণা করা হয়, তাঁর নাম থেকেই “চাঁপাই” শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।

অন্য একটি মত অনুযায়ী, এই অঞ্চলে প্রাচীন কালে রাজা লখিন্দরের বাসভূমি ছিল এবং তাঁর রাজধানীর নাম ছিল “চম্পকনগর”। সময়ের পরিক্রমায় “চম্পক” থেকেই “চাঁপাই” শব্দটি বিবর্তিত হয়েছে বলে ধারণা করেন কিছু গবেষক।

ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর বাঙলা সাহিত্যের কথা গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে উল্লেখ করেছেন যে, লাউসেনের শত্রুরা জামুতিনগর দিয়ে গৌড়ে প্রবেশ করে। বর্তমানে ভোলাহাট উপজেলার জামবাড়িয়া গ্রাম অতীতে “জামুতিনগর” নামে পরিচিত ছিল।

এই তথ্যে ভিত্তি করে কেউ কেউ চাঁপাই অঞ্চলকে বেহুলার শ্বশুরবাড়ি “চম্পকনগর” বলে চিহ্নিত করে থাকেন এবং “চম্পক” শব্দ থেকেই “চাঁপাই” নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন।

এইসব মত ও ইতিহাস মিলিয়ে বলা যায়, “চাঁপাইনবাবগঞ্জ” নামটি নানা ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও লোককথার মিশ্রণে গঠিত একটি নাম, যা আজ জেলার পরিচিতি বহন করছে।

১. প্রাচীন ইতিহাস (Ancient History)

এই অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে। গোমস্তাপুর ও ভোলাহাট এলাকায় খননকাজে প্রাপ্ত পাথরের সরঞ্জাম,

পোড়ামাটির পাত্র ও প্রাচীন স্থাপত্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রাচীন সভ্যতার ইঙ্গিত দেয়। এই অঞ্চল প্রাচীন মগধ, মৌর্য এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের অংশ ছিল বলে ধারণা করা হয়।

২. মধ্যযুগের ইতিহাস (Medieval Period)

সুলতানী ও মুঘল আমলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল। বার ভূঁইয়াদের মধ্যে স্থানীয় জমিদাররা এখানে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছিলেন।

এছাড়া শাহ নেয়ামতুল্লাহ ওয়ালীর আগমন এই অঞ্চলের ধর্মীয় ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সৃষ্টি করে। তাঁকে কেন্দ্র করে অনেক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

৩. ঔপনিবেশিক শাসনকাল (Colonial Period)

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা বাংলার ক্ষমতা গ্রহণ করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জও ব্রিটিশ শাসনের আওতায় আসে। এই সময় কৃষি ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে, বিশেষ করে নীলচাষের কারণে।

জেলার বহু মানুষ এই দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় স্থানীয় জনগণের কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

৪. পাকিস্তান শাসনামল (1947-1971)

ব্রিটিশদের বিদায়ের পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। এই সময় ভাষা আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন এবং স্বাধীনতার প্রস্তুতির নানা কার্যক্রমে এ জেলার মানুষ অংশগ্রহণ করে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই জেলার মানুষ সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শিবগঞ্জ ও কানসাট এলাকায় সংঘর্ষ এবং বধ্যভূমির অস্তিত্ব এর প্রমাণ বহন করে।

আরও পড়ুনঃ লালমনিরহাট নামকরণের ইতিহাস

৫. স্বাধীনতা-উত্তর চাঁপাইনবাবগঞ্জ (Post independence Developments)

স্বাধীনতার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ ১৯৮৪ সালের ১লা মার্চ পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় জেলার কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটে।

বিশেষ করে আম চাষ ও রপ্তানিতে এই জেলার পরিচিতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। কানসাট বিদ্রোহ (২০০৬) এক উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ঘটনা, যা স্থানীয় বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে সংঘটিত হয়।

শেষ কথা

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ইতিহাস একটি গভীর ও বৈচিত্র্যময় অধ্যায়। এই জেলার ইতিহাস শুধু একটি এলাকার নয়। বরং এটি বাংলার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

ইতিহাসের ধারায় এই অঞ্চল একদিকে যেমনঃ সাহসিকতা ও প্রতিরোধের প্রতীক, অন্যদিকে এটি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যেরও ধারক বাহক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button