ঠাকুরগাঁও জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ঠাকুরগাঁও জেলা শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কিংবা অর্থনৈতিক গুরুত্বেই নয়, বরং ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকেও একটি বিশিষ্ট অবস্থান দখল করে আছে।
এই জেলার নামকরণের পেছনে রয়েছে নানা জনশ্রুতি, ঐতিহাসিক দলিল এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের অবদান। অনেকেই জানেন না যে ঠাকুরগাঁওয়ের আদি নাম ছিল ‘নিশ্চিন্তপুর’।কালের আবর্তে সেই নামটি বিলুপ্ত হয়ে আজ আমরা যাকে ঠাকুরগাঁও নামে জানি, তার জন্ম হয়েছে একটি অনন্য ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়। নামকরণের ইতিহাস শুধু একটি ভূখণ্ডের পরিচয় নয়।
বরং তা একটি জনপদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিকাশের প্রতিচ্ছবি। এই আর্টিকেলে আমরা ঠাকুরগাঁও জেলার নামকরণের ইতিহাস অনুসন্ধান করে দেখবো কীভাবে ‘নিশ্চিন্তপুর’ হয়ে উঠল ‘ঠাকুরগাঁও’ এবং এর পেছনে কোন প্রেক্ষাপট ও ঘটনা কাজ করেছিল।
ঠাকুরগাঁও জেলার নামকরণের ইতিহাস?
‘নিশ্চিন্তপুর’ শব্দটি উচ্চারিত হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিশ্চিন্তে, শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের উপযোগী কোনো গ্রাম বা জনপদের চিত্র। অনেকের মনে পড়ে যায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস পথের পাঁচালী তে বর্ণিত সেই নিশ্চিন্তপুর গ্রামের কথা।
কিন্তু এই নামটি উচ্চারিত হলে খুব কম মানুষই আজ স্মরণ করেন উত্তরের জনপদ ঠাকুরগাঁওয়ের কথা। কারণ বহুদিন আগেই ঠাকুরগাঁওয়ের আদি নাম ‘নিশ্চিন্তপুর’ ইতিহাসের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে।
জনশ্রুতি আছে, কোনো এক সময় ঠাকুরগাঁও অঞ্চলটি ‘নিশ্চিন্তপুর’ নামেই পরিচিত ছিল। এই নাম সাধারণ মানুষের কাছে ছিল পরিচিত ও আপন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এবং কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির ইচ্ছাপূরণে ‘নিশ্চিন্তপুর’ নামটি মুছে গিয়ে এর জায়গা নেয় ‘ঠাকুরগাঁও’।
ফলে আজ এই অঞ্চলের আদি পরিচয় প্রায় ভুলেই গেছে মানুষ। তবে ইতিহাস-সচেতন মানুষের হৃদয়ে এখনো ‘নিশ্চিন্তপুর’ নামটি আবেগ ও স্মৃতিতে শিহরণ তোলে। অনেকদিন ধরেই ‘নিশ্চিন্তপুর’ নামটি ঠাকুরগাঁওয়ের আদি নাম বলে অনুমান করা হতো,
তবে তা ছিল মূলত জনশ্রুতি ও কিছু মৌজার নামের ওপর নির্ভরশীল। নির্ভরযোগ্য কোনো প্রামাণ্য দলিল ছিল না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে একটি ১৭শ শতাব্দীর কোচবিহারের প্রাচীন মানচিত্র আবিষ্কৃত হওয়ায় সে ধারণা আজ ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত সত্যে রূপ পেয়েছে।
ওই মানচিত্রে ঠাকুরগাঁও ও নিশ্চিন্তপুর দুটি পৃথক জনপদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মানচিত্র অনুযায়ী, টাঙ্গন নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত নিশ্চিন্তপুর এবং এর কিছুটা উত্তর-পশ্চিমে, নদীর অপর পারে ঠাকুরগাঁও চিহ্নিত রয়েছে।
এই মানচিত্র থেকেই স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়, টাঙ্গন নদীর পূর্ব তীরের প্রাচীন নিশ্চিন্তপুরই পরবর্তীকালে ঠাকুরগাঁও নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রশাসনিক প্রয়োজন ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিশ্চিন্তপুরকে ঠাকুরগাঁওতে রূপান্তরিত করা হয়।
প্রথমে মহকুমা, পরে জেলা হিসেবে ‘ঠাকুরগাঁও’ নামেই তা প্রতিষ্ঠা পায়। ঠাকুরগাঁওয়ের নামকরণের আরও একটি প্রচলিত ইতিহাস রয়েছে। বর্তমানে যে স্থানটিকে জেলা সদর হিসেবে চিনি, তার উত্তরদিকে আকচা ইউনিয়নের একটি মৌজায় বসবাস করতেন নারায়ণ চক্রবর্তী ও সতীশ চক্রবর্তী নামে দুই প্রভাবশালী ভ্রাতা।
তাদের প্রভাব ও অর্থবিত্তের কারণে স্থানীয় মানুষ তাদের বাসভবনকে ‘ঠাকুরবাড়ি’ নামে ডাকতো। সময়ের পরিক্রমায় সেই ঠাকুরবাড়ির নামই রূপান্তরিত হয়ে হয় ‘ঠাকুরগাঁও’। চক্রবর্তী পরিবার ব্রিটিশ শাসনের আমলে এই অঞ্চলে একটি থানার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
আরও পড়ুনঃ রংপুর নামকরণের ইতিহাস
তাদের প্রস্তাবে জলপাইগুড়ির জমিদার বৃটিশ সরকারকে রাজি করিয়ে ১৮০০ সালের গোড়ার দিকে ঠাকুরগাঁওয়ে একটি থানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এই থানা টাঙ্গন নদীর পূর্ব তীরের নিশ্চিন্তপুরে স্থানান্তরিত হয়
এবং এর আশেপাশেই গড়ে ওঠে প্রশাসনিক কাঠামো। এই থানাকে কেন্দ্র করেই ১৮৬০ সালে ১০টি থানা নিয়ে ঠাকুরগাঁও মহকুমা গঠিত হয়। পরবর্তীকালে বর্তমান পঞ্চগড় জেলার পাঁচটি থানা এই মহকুমার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অবশেষে ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাঁও বাংলাদেশের একটি পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যদিও প্রশাসনিকভাবে ঠাকুরগাঁও জেলার পরিচিতি সাম্প্রতিক, তবে জনপদ হিসেবে এর ইতিহাস বহু প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী এবং সমৃদ্ধ।
শেষ কথা
প্রাচীন নিশ্চিন্তপুর থেকে আধুনিক ঠাকুরগাঁও এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে ইতিহাস, জনশ্রুতি, ও স্থানীয় অভিজাতদের প্রভাব। আজকের প্রজন্মের উচিত এই আদি ইতিহাসকে জানার ও সংরক্ষণ করার মধ্য দিয়ে নিজেদের শেকড়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়া।
নিশ্চিত বসবাসের প্রতীক সেই ‘নিশ্চিন্তপুর’ এর নাম হয়তো বদলে গেছে, তবে ইতিহাসে তার উপস্থিতি আজও অমলিন।