পড়াশোনা

ফেনী জেলার নামকরণের ইতিহাস

ফেনী জেলার নামকরণের ইতিহাস বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলার সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক পরিচয়ের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত।

প্রশাসনিক ও ভৌগোলিকভাবে এটি চট্টগ্রাম বিভাগের অংশ হলেও, ফেনীর নামকরণ ও ইতিহাস একটি স্বতন্ত্র পরিচয় বহন করে। এই অঞ্চলের নদ-নদী, ভূপ্রকৃতি ও স্থানীয় জনজীবনের প্রভাবেই “ফেনী” নামের উৎপত্তি বলে অনেক মত রয়েছে।ফেনী জেলার নামকরণের ইতিহাসফেনী নামের পেছনে রয়েছে নানা জনশ্রুতি, ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা এবং ভৌগোলিক উপাদানের সংমিশ্রণ। এই জেলার নামকরণের পেছনে ইতিহাস, ভাষা এবং সংস্কৃতির যে অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা রয়েছে,

তা অনুধাবন করা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। এই আর্টিকেলে আমরা ফেনী জেলার নামকরণের উৎস, ইতিহাস ও প্রাসঙ্গিক জনশ্রুতি নিয়ে আলোচনা করব।

ফেনী জেলার নামকরণের ইতিহাস?

ফেনী জেলার নামকরণের উৎস খুঁজতে গেলে পাওয়া যায় এক ঐতিহাসিক নদীর নাম ফেনী নদী। ধারণা করা হয়, এই নদীর নাম থেকেই এ অঞ্চলের নাম “ফেনী” হয়েছে।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে “ফনী” শব্দটির উল্লেখ দেখা যায়, যা তখন একটি নদীর স্রোতধারা ও ফেরী পারাপারের ঘাট বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। ষোড়শ শতকে রচিত কবি কবীন্দ্র পরমেশ্বরের কাব্যগ্রন্থে ফেনী নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি পরাগলপুরের বর্ণনায় লেখেনঃ

“ফনী নদীতে বেষ্টিত চারিধার, পূর্বে মহাগিরি পার নাই তার।”এই পঙক্তি থেকে স্পষ্ট যে, ফনী নদী অঞ্চলের ভূগোল ও পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

পরবর্তীতে সপ্তদশ শতকে মির্জা নাথান রচিত ফার্সি ভাষার ঐতিহাসিক গ্রন্থ বাহরিস্তান-ই-গায়েবী-তে “ফনী” শব্দটির পরিবর্তিত রূপ “ফেনী” পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, এ সময় থেকেই “ফেনী” শব্দটি প্রচলিত হয়।

আঠারো শতকের শেষার্ধে কবি আলী রজা ওরফে কানু ফকির তার পীরের বসতি হাজীগাঁও এর অবস্থান বর্ণনায় বলেনঃ

“ফেনীর দক্ষিণে এক ষর উপাম, হাজীগাঁও করিছিল সেই দেশের নাম।”

অন্যদিকে কবি মুহম্মদ মুকিম তার পৈতৃক বসতির বর্ণনায় লেখেনঃ

“ফেনীর পশ্চিমভাগে জুগিদিয়া দেশে।”

এই দুই কবিই নদী অর্থে “ফেনী” শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যা পূর্বের “ফনী” শব্দের একটি রূপান্তর।

অতএব ভাষাগত বিবর্তনের ধারায় “ফনী” শব্দটি মুসলমান কবি ও সাহিত্যিকদের ব্যবহারে “ফেনী” তে রূপান্তরিত হয়েছে। নদীঘেরা অঞ্চল হিসেবে এর ভৌগোলিক তাৎপর্য ও সাহিত্যিক প্রমাণসমূহ মিলিয়ে দেখা যায়, ফেনী নামটির উৎপত্তি ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক গভীর ধারার প্রতিফলন।

ফেনী জেলা ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের প্রশাসনিক পুনর্গঠনের সময় জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পূর্বে এটি নোয়াখালী জেলার একটি মহকুমা ছিল। ফেনী মহকুমার গোড়াপত্তন ঘটে ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে,

যখন মীরসরাই, ছাগলনাইয়া এবং আমীরগাঁও এলাকাগুলিকে একত্র করে নতুন মহকুমা গঠন করা হয়। এই মহকুমার প্রথম প্রশাসক ছিলেন বিশিষ্ট কবি ও প্রশাসক নবীনচন্দ্র সেন।

১৮৭৬ সালে মীরসরাই অঞ্চলকে কর্তন করে চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সে সময় মহকুমা সদর দপ্তর ছিল আমীরগাঁওয়ে। মোগল আমলের আমীরগাঁও থানা ১৮৭২ থেকে ১৮৭৪ সালের মধ্যে নদীভাঙনের ফলে স্থানান্তরিত হয়ে

ফেনী নদীর ঘাটের কাছাকাছি খাইয়ারাতে স্থাপিত হয়। এর পরবর্তী পর্যায়ে এই স্থানটিই “ফেনী থানা” নামে পরিচিত লাভ করে। ১৮৭৬ সালে ফেনী মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে খাইয়ারার থানা দপ্তরটি মহকুমা সদরে স্থানান্তর করা হয়

এবং নতুন মহকুমাটির নাম রাখা হয় “ফেনী”। পরবর্তীতে ১৮৮১ সালে মহকুমা সদর দপ্তরটি স্থানান্তরিত হয়ে বর্তমান ফেনী শহরে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

এইভাবে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ফেনী অঞ্চল একটি প্রশাসনিক মহকুমা থেকে পর্যায়ক্রমে একটি পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যার ভিত্তি গড়ে উঠেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে।

প্রাচীন ইতিহাসে ফেনী অঞ্চল

দূর অতীতে ফেনী অঞ্চল ছিল সাগরের অংশ। তবে উত্তর-পূর্ব দিকে এটি পাহাড়ি অঞ্চলের পাদদেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। বিশেষত রঘুনন্দন পাহাড় থেকে শুরু করে কাজিরবাগের পোড়ামাটির অঞ্চল পর্যন্ত এলাকায়

আদিকালে শিকারী মানুষের বিচরণ ছিল বলে ধারণা করা হয়। ১৯৬৩ সালে ছাগলনাইয়া উপজেলার একটি গ্রামে পুকুর খননের সময় নব্য প্রস্তর যুগের একটি হাতকুড়াল আবিষ্কৃত হয়,

যা প্রমাণ করে এখানে প্রাচীন মানব বসতির অস্তিত্ব ছিল। পণ্ডিতদের মতে, এই হাতকুড়ালটি প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের, যা এই অঞ্চলের প্রাচীনত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে।

শিলুয়া ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির সম্ভাবনা

ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার শিলুয়া গ্রামে একটি প্রাচীন শিলামূর্তির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে।

ধারণা করা হয়, এই শিলামূর্তি থেকেই ‘শিলুয়া’ বা ‘শিল্লা’ নামের উৎপত্তি। প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে অনুমান করা হয় যে, এই অঞ্চলে এক সময় বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটেছিল।

পরিবেশগত রূপ ও নামকরণের ইতিহাস

ড. আহমদ শরীফ তাঁর “চট্টগ্রামের ইতিকথা” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, প্রাচীনকালে বর্তমান ফেনী অঞ্চল ছাড়া বৃহত্তর নোয়াখালীর বেশিরভাগ অংশ ছিল নিম্ন জলাভূমি।

সে সময় ভুলুয়া (নোয়াখালীর প্রাচীন নাম) ও জুগিদিয়া (ফেনী নদীর মোহনায় অবস্থিত অঞ্চল) ছিল দ্বীপ সদৃশ।ছাগলনাইয়া নামকরণের ক্ষেত্রে একটি জনশ্রুতি রয়েছে। বলা হয়, ইংরেজ শাসনের প্রারম্ভে “সাগর” (Shagor) শব্দটি ভুলক্রমে “ছাগল” (Chagol) রূপে লিপিবদ্ধ হয়।

এই ভুল থেকে “ছাগলনাইয়া” নামটির উৎপত্তি ঘটে। উল্লেখযোগ্য যে, ইংরেজ শাসনের পূর্ববর্তী কোন গ্রন্থে বা পুঁথিতে “ছাগলনাইয়া” নামক স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায় না।

আরও পড়ুনঃ বগুড়া জেলার নামকরণের ইতিহাস

শমসের গাজী ও তাঁর শাসন

অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফেনী নদীর তীরে রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে বাঙালি বীর শমসের গাজী তাঁর রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকে তিনি রৌশনাবাদ ও ত্রিপুরা রাজ্যে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করে সাফল্য লাভ করেন।

তাঁর শাসনকালে চম্পকনগরের একাংশের নামকরণ করা হয় “জগন্নাথ সোনাপুর”, যা তাঁর ঐতিহাসিক প্রভাবকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button