খাগড়াছড়ি জেলার নামকরণের ইতিহাস
খাগড়াছড়ি জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা জীবনধারা এবং আদিবাসী সংস্কৃতির কারণে এই অঞ্চলটি বিশেষভাবে পরিচিত।খাগড়াছড়ি নামটির উৎপত্তি ও ইতিহাস একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বহন করে। এই জেলার নামকরণ নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন জনশ্রুতি, ইতিহাস এবং স্থানীয়দের মুখে মুখে প্রচলিত কাহিনি।
খাগড়াছড়ির নামকরণের পেছনে স্থানীয় ভাষা, ভূপ্রকৃতি এবং সামাজিক ঐতিহ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই আর্টিকেলে আমরা খাগড়াছড়ি জেলার নামের উৎস ও ইতিহাস বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব, যা এই অঞ্চলের অতীতকে জানতে ও বুঝতে সাহায্য করবে।
খাগড়াছড়ি জেলার নামকরণের ইতিহাস?
খাগড়াছড়ি জেলার প্রাচীন নাম ছিল ‘তারক’। কালের প্রবাহে এই নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘খাগড়াছড়ি’তে রূপ নেয়। এ নামের উৎস নিহিত রয়েছে এক প্রাকৃতিক নিদর্শনের মধ্যে।
খাগড়াছড়ি শহরের বুক চিরে প্রবাহিত হয়েছে একটি ছড়া নদী, যা এই অঞ্চলের জীবনধারার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই ছড়া নদীর দু’পাড়ে একসময় বিস্তৃত ছিল ঘন নল খাগড়ার বন।
স্থানীয় মানুষের ভাষায়, নল খাগড়া একটি ধরনের লম্বা ঘাসজাত উদ্ভিদ, যা জলে বা আর্দ্র অঞ্চলে জন্মে। এই নল খাগড়ার বন ছিল এলাকাবাসীর জন্য একটি পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ ভূ-প্রকৃতিক উপাদান।
এই নল খাগড়ার ঘন বন এবং নদীঘেরা ছড়া মিলেই এলাকাটিকে ‘খাগড়াছড়ি’ নামে পরিচিত করে তোলে। এখানে ‘খাগড়া’ বোঝায় নল খাগড়া উদ্ভিদ এবং ‘ছড়ি’ বোঝায় ছোট নদী বা ছড়া।
এভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশের অনন্য বৈশিষ্ট্য থেকেই জন্ম নেয় ‘খাগড়াছড়ি’ নামটি, যা আজ এই পার্বত্য জেলার পরিচয় বহন করে চলেছে। খাগড়াছড়ি জেলার ইতিহাস বহু পুরনো এবং বৈচিত্র্যময়।
খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়ে এই এলাকা বিভিন্ন শাসকের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কখনো ত্রিপুরা রাজন্যবর্গ আবার কখনো আরাকান রাজাগণ এ অঞ্চল শাসন করেছেন।
৫৯০ থেকে ৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৬৩ বছর ত্রিপুরা রাজাগণ বংশপরম্পরায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলসহ খাগড়াছড়ি এবং চট্টগ্রাম শাসন করেন। পরবর্তীকালে ৯৫৩ থেকে ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত
আরাকান রাজাগণ ২৯৭ বছর ধরে এ অঞ্চল শাসন করলেও, ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ আরও ১০২ বছর ত্রিপুরা রাজাগণ পুনরায় এ এলাকার কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন।
দশম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে ত্রিপুরা রাজাগণ আটবার, আরাকান রাজাগণ নয়বার এবং গৌড়ের মুসলিম সুলতানগণ ছয়বার পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন।
অবশেষে ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ত্রিপুরা রাজার আধিপত্যের অবসান ঘটান। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে
যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন নবাব মীর কাশিম আলীর আমলে ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। পরের বছর, ১৭৬১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশদের সাথে ত্রিপুরা মহারাজার যুদ্ধ সংঘটিত হয়
এবং পরাজয়ের ফলে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঐ চুক্তির ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়, “চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের রাজস্ব ও প্রশাসনিক নির্বাহী ক্ষমতা ইংরেজ সরকারের হাতে থাকবে”। এই ধারার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম ত্রিপুরা রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে যায়।
১৮৬০ সালের ২৬ জুন পার্বত্য চট্টগ্রামকে চট্টগ্রাম থেকে পৃথক করে স্বতন্ত্র জেলা ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৮৮১ সালের ১ সেপ্টেম্বর অঞ্চলটিকে প্রশাসনিক ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে তিনটি সার্কেল মং সার্কেল, চাকমা সার্কেল ও বোমাং সার্কেলে ভাগ করা হয়।
একই বছর ব্রিটিশ সরকার “পার্বত্য চট্টগ্রাম ফ্রন্টিয়ার পুলিশ অ্যাক্ট” প্রণয়ন করে, যার মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয়। ১৯০০ সালের ১ মে ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ নামে একটি আইন প্রণয়ন করে,
যার মাধ্যমে অঞ্চলটি বিশেষভাবে শাসিত হতে থাকে। যদিও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন পাশ হয়, তবুও পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯০০ সালের আইনই বলবৎ থাকে।
এই আইনে উপজাতীয় জনগণের ভূমি অধিকার সংরক্ষিত ছিল এবং বাইরের অউপজাতীয়দের জমি বন্দোবস্ত পাওয়ার ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম ছিল। ১৯২০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে “Excluded Area”, ১৯৬২ সালে “উপজাতি অঞ্চল”,
এবং ১৯৬৪ সালে সাধারণ এলাকা ঘোষণা করা হয়, ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু রাজনৈতিক চাপের ফলে এক নির্বাহী আদেশে সেই আইন পুনর্বহাল করে অঞ্চলটিকে “উপজাতীয় এলাকা” ঘোষণা করা হয়।
এই সময় সরকারের কিছু কার্যক্রম, যেমন অউপজাতীয়দের জমি মালিকানা প্রদান সহজ করা, উপজাতীয় জনগণের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করে।
স্বাধীনতার পর সরকার পার্বত্য অঞ্চলে জনসংখ্যা ভারসাম্য আনয়নের উদ্যোগ অব্যাহত রাখে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এতে অঞ্চলটির সমস্যা রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে খাগড়াছড়ি জেলায় সামগ্রিক উন্নয়ন অবকাঠামো গড়ে ওঠে।
আরও পড়ুনঃ রংপুর নামকরণের ইতিহাস
রাস্তাঘাটের উন্নয়নের ফলে জেলা সদরের সাথে প্রত্যন্ত উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। স্থানীয় আদিবাসী সংস্কৃতির সঙ্গে বৃহত্তর জাতীয় সংস্কৃতির সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে খাগড়াছড়ির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে।
শেষ পর্যন্ত, ১৯৮৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি জেলা শহরের একটি অংশ নিয়ে খাগড়াছড়ি পৌরসভা গঠিত হলে শহরটি পৌর শহরের মর্যাদা লাভ করে।