রাঙ্গামাটি জেলার নামকরণের ইতিহাস
রাঙ্গামাটি, বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ পার্বত্য জেলা। এই জেলার নামকরণ ইতিহাস ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও ভূপ্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত।
“রাঙ্গামাটি” নামটির উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ ও জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, ‘রাঙ্গা’ অর্থ লাল এবং ‘মাটি’ অর্থ ভূমি অর্থাৎ লাল মাটির অঞ্চল হিসেবে এই নামটি এসেছে।আবার অনেকের মতে, তৎকালীন পাহাড়ি অঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাবেও এই নামটির উৎপত্তি ঘটেছে। ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চল এক সময় “কার্পাস মহল” নামে পরিচিত ছিল,
যা তুলা উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল। পরবর্তীতে প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ধারায় ‘রাঙ্গামাটি’ নামে এর পরিচিতি প্রতিষ্ঠা পায়। জেলার নামকরণ ও বিকাশ ইতিহাস রাঙ্গামাটির বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক পরিচয় ও পার্বত্য জীবনধারার প্রতিচ্ছবি বহন করে।
রাঙ্গামাটি জেলার নামকরণের ইতিহাস?
ব্রিটিশদের আগমনের অনেক আগেই রাঙ্গামাটি তথা তৎকালীন কার্পাস মহল ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও কৌশলগত যুদ্ধক্ষেত্র। এই অঞ্চল নিয়ে ত্রিপুরা, মুঘল, চাকমা ও আরাকানের রাজাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দখলদারিত্বের লড়াই চলেছিল।
সেই সময় চাকমা রাজা বিজয়গিরি রাজ্য দখল করে কার্পাস মহলের অধিকাংশ এলাকা জয় করেন এবং এখানে নিজস্ব শাসনব্যবস্থা ও রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
১৬৬৬ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী এই অঞ্চলের কিছু অংশে অনুপ্রবেশ করলেও তারা চাকমা রাজার হাতে পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে মুঘলদের ব্যবহৃত দুটি কামানের মধ্যে একটি, যার নাম ছিল ‘ফতেহ্ খাঁ’,
তা চাকমা রাজার হস্তগত হয় এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে গুরুত্ব পায়। পরবর্তী সময়ে, ১৭৩৭ সালে চাকমা রাজা শের মোস্তা খান মুঘলদের বিরুদ্ধে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করেন
এবং তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে এই অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করেন। এতে করে চাকমা রাজ্যের কর্তৃত্ব আরও সুসংহত হয়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়, ১৭৬০-৬১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলে প্রবেশ করে
এবং ধীরে ধীরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ব্রিটিশ শাসনামলে পার্বত্য অঞ্চলের প্রশাসনিক কাঠামোতে নানা পরিবর্তন সাধিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনার পর, আশির দশকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে,
প্রায় চার লক্ষ ভূমিহীন বাঙালি পরিবারকে রাঙ্গামাটিসহ পার্বত্য অঞ্চলে পুনর্বাসিত করা হয়। এই পুনর্বাসন কার্যক্রম নতুন এক জনবসতির ধারা তৈরি করে এবং বর্তমানে এসব বাঙালি পরিবারও এই অঞ্চলের অবিচ্ছেদ্য জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় ১৪টি স্বীকৃত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বাস করে, যারা তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারায় বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা সহ এইসব নৃগোষ্ঠী
এবং বাঙালি সম্প্রদায় মিলেই গড়ে উঠেছে রাঙ্গামাটির সমৃদ্ধ ও বহুস্তরীয় সামাজিক কাঠামো। ১৮৬০ সালের ২০ জুন তারিখে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান এই তিনটি পার্বত্য অঞ্চলকে নিয়ে গঠিত হয় “পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা”।
জেলা প্রতিষ্ঠার পূর্বে এই অঞ্চলের নাম ছিল কার্পাস মহল, যার অর্থ সূচিবস্ত্র বা তুলা উৎপাদন এলাকা। ব্রিটিশ শাসনের সময় এই নামটি প্রচলিত ছিল এবং এ অঞ্চল তখনও একটি স্বতন্ত্র ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক পরিচয় বহন করত।
পরে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে ১৯৮১ সালে বান্দরবান এবং ১৯৮৩ সালে খাগড়াছড়ি পৃথক জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার মূল অংশটি “রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা” নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুনঃ পিরোজপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস
এবং বর্তমানে এটি স্বতন্ত্র একটি জেলা হিসেবেই বিদ্যমান। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা প্রথাগত রাজস্ব আদায় ব্যবস্থায় এখনও বিশেষ ঐতিহ্য বহন করে। এখানে চাকমা সার্কেল চীফ বা সার্কেল প্রধানের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনিক কাঠামো বজায় আছে।
এই সার্কেল চীফ পদটি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত একটি পদ, এবং চাকমা রাজা-ই হলেন এই নিয়মতান্ত্রিক সার্কেল চীফ। চাকমা রাজার নেতৃত্বে এই অঞ্চল প্রথাগত ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়, যা আজও এখানকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।