পড়াশোনা

সিলেট জেলার নামকরণের ইতিহাস

বাংলার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক জনপদ হচ্ছে সিলেট। এই অঞ্চল তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় সম্প্রীতি, আধ্যাত্মিক ধারা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য প্রসিদ্ধ।সিলেট জেলার নামকরণের ইতিহাসসিলেট নামটির পেছনে রয়েছে বহুমাত্রিক ইতিহাস ও জনশ্রুতি, যা প্রাচীন ধর্মীয় বিশ্বাস, বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ, মুসলিম বিজয় ও শাসন এবং লোককাহিনির ধারায় বিকশিত হয়েছে।

শ্রীহট্ট থেকে সিলেট নামের বিবর্তনের যে যাত্রা, তা এ অঞ্চলের ইতিহাসের ধারাবাহিক রূপান্তর এবং বহুজাতিক প্রভাবের সাক্ষ্য বহন করে। এই আর্টিকেলে সিলেট জেলার নামকরণের উৎস ও এর বিবর্তন নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।

সিলেট জেলার নামকরণের ইতিহাস?

সিলেট নামটির উৎপত্তি নিয়ে বহু মত প্রচলিত রয়েছে, যা হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রাচীন বিদেশি লেখকদের বিবরণ, মুসলিম ঐতিহ্য এবং লোককথার ওপর ভিত্তি করে গঠিত।

হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস

হিন্দু শাস্ত্র মতে, দেবতা শিবের পত্নী সতী দেবীর দেহ ছিন্নভিন্ন হওয়ার পর তার কাটা হস্ত (হাত) এই অঞ্চলে পতিত হয়। এই ঘটনার স্মরণে হিন্দু সম্প্রদায় এই স্থানের নামকরণ করেন ‘শ্রী হস্ত’,

যা পরবর্তীকালে রূপান্তরিত হয়ে ‘শ্রীহট্ট’ নাম ধারণ করে। হিন্দু সমাজের মতে, এখান থেকেই সিলেট নামের উৎপত্তির প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপিত হয়।

প্রাচীন বিদেশি ইতিহাসে উল্লেখ

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্রিক ঐতিহাসিক এরিয়ান তার বিবরণে এই অঞ্চলের নাম উল্লেখ করেন “সিরিওট” নামে।
খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে লেখক এলিয়েন (Aelian) এই স্থানকে “সিরটে” নামে চিহ্নিত করেন।

এছাড়াও প্রাচীন নৌ ভ্রমণ কাহিনী Periplus of the Erythraean Sea নামক গ্রন্থে অঞ্চলটির নাম “সিরটে” এবং “সিসটে” এই দুটি রূপে পাওয়া যায়।

চীনা ভ্রমণকারীর বিবরণ

৬৪০ খ্রিস্টাব্দে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এই অঞ্চল সফর করেন। তিনি তার ভ্রমণবৃত্তান্তে এই এলাকাকে “শিলিচতল” নামে অভিহিত করেন, যা এই অঞ্চলের একটি প্রাচীন রূপ হিসেবে বিবেচিত হয়।

মুসলিম ঐতিহ্য ও শাসনামলে নাম পরিবর্তন

১২০৪ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী বঙ্গবিজয়ের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে মুসলিম শাসনের সূত্রপাত ঘটান। মুসলিম শাসকগণ তাদের দলিলপত্রে ‘শ্রীহট্ট’ নামটির পরিবর্তে ‘সিলাহেট’,

‘সিলহেট’ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করতে থাকেন। কালের পরিক্রমায় এই নামের বিবর্তন ঘটতে ঘটতে বর্তমান সিলেট নামটি গৃহীত হয় এবং প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে।

আধ্যাত্মিক কাহিনীঃ হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ)

জনশ্রুতি অনুসারে, হযরত শাহ্ জালাল (রহঃ) যখন তার ৩৬০ জন অনুসারী আউলিয়াসহ সিলেট আগমন করেন, তখন শত্রুরা তাদের ‘শিলা’ বা পাথর দিয়ে আটকে দেয়। শাহ্ জালাল (রহঃ) আল্লাহর সাহায্যে উচ্চারণ করেন “শিলাহাট” (অর্থাৎ ‘পাথর সরে যা’)।

অলৌকিকভাবে পাথর সরে গেলে এলাকাটি পরিচিতি পায় ‘শিলাহাট’ নামে। পরবর্তীতে নামটি ধাপে ধাপে সহজ হয়ে হয়ে ওঠে শিলহাট, সিলাহেট এবং অবশেষে সিলেট।

লোককথাঃ শিলার হাট

আরেকটি লোককথা অনুযায়ী, একসময় সিলেটে এক ধনী ব্যক্তির কন্যার নাম ছিল শিলা। তার স্মৃতিতে তিনি একটি হাট স্থাপন করেন, যার নাম দেন শিলার হাট। কালের প্রবাহে এই শিলার হাট নামটি বিবর্তিত হয়ে পরিণত হয় আজকের সিলেট নামে।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত সিলেট জেলা একটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং অর্থনৈতিক গুরুত্বে সমৃদ্ধ অঞ্চল। প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চল পুণ্যভূমি ও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল।

হযরত শাহজালাল (র.) ও হযরত শাহপরাণ (র.) সহ ৩৬০ আউলিয়ার পদচারণায় পবিত্র এ ভূমি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যে অনন্য।

নামকরণের ইতিহাস?

সিলেট নামের উৎপত্তি সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রচলিত। হিন্দু পৌরাণিক মতে, ‘শ্রী’ অর্থ প্রাচুর্য বা সৌন্দর্য এবং ‘হট্ট’ অর্থ বাজার। এই ‘শ্রীহট্ট’ নামের বিকৃতিই ‘সিলেট’।

আবার কেউ কেউ মনে করেন ‘শীলা’ (পাথর) ও ‘হাট’ (বাজার) থেকে সিলেট নামের উদ্ভব। মুসলিম ভ্রমণকারী আল-বিরুনি তাঁর ‘কিতাবুল হিন্দ’ গ্রন্থে সিলেটকে ‘সিলাহট’ নামে উল্লেখ করেন।

প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস

চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে তার ভ্রমণ বিবরণীতে এ অঞ্চলের উল্লেখ করেছেন। দশম শতকে মহারাজা শ্রীচন্দ্র কর্তৃক উৎকীর্ণ তাম্রলিপি সিলেট জয় করার দলিল সরূপ বিবেচিত।

১৪ শতকে ইয়েমেন থেকে আগত সাধক হযরত শাহজালাল (র.) সিলেট জয় করে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। এই সময় থেকেই এ অঞ্চলে মুসলিম সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করে। মুঘল যুগে পাঠান নেতা খাজা ওসমান মুঘলদের বিরুদ্ধে সিলেট রক্ষায় লড়াই করেন।

ঔপনিবেশিক ও আধুনিক ইতিহাস

১৭৭২ সালের ১৭ মার্চ সিলেট জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রথমে ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৭৪ সালে এটি নবগঠিত আসাম প্রদেশে যুক্ত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারতের বিভাজনের সময় গণভোটে সিলেট পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৯৮৩-৮৪ সালে বৃহত্তর সিলেট জেলা চারটি জেলায় বিভক্ত হয়ঃ সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার। ১৯৯৫ সালের ১ আগস্ট সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠা পায়।

ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য

সিলেট জেলার আয়তন ৩,৪৫২.০৭ বর্গকিলোমিটার। উত্তরে ভারতের খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পাহাড়, দক্ষিণে মৌলভীবাজার, পূর্বে কাছাড় ও করিমগঞ্জ, পশ্চিমে সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ অবস্থিত। সিলেট নদ-নদী, হাওর-বিল, পাহাড়-টিলা ও বনাঞ্চলে সমৃদ্ধ।

এখানে রয়েছে হাকালুকি হাওরের অংশবিশেষ এবং দেশের দীর্ঘতম নদী সুরমা (৩৫০ কি.মি.)। কুশিয়ারা নদী এ জেলার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী।

প্রাকৃতিক সম্পদ ও পর্যটন

সিলেট চা চাষ, প্রাকৃতিক গ্যাস, চুনাপাথর ও কঠিন শিলার জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও লালাখাল, জাফলং, ভোলাগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও বিভিন্ন চা বাগান এ জেলার পর্যটন খাতে সম্ভাবনাময় স্থান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদের এই সমাহার দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

শিক্ষা ও নগরায়ণ

ঔপনিবেশিক আমলে ১৮৭৮ সালে সিলেট পৌরসভা গঠিত হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্প শহর ধ্বংস করলেও, ইউরোপীয় নকশায় এটি পুনর্নির্মিত হয়।

আসাম বেঙ্গল রেল সংযোগের মাধ্যমে অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সিলেটের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। বর্তমানে শহরটি দ্রুত নগরায়িত ও শিক্ষার হার ৬৬.৯%।

প্রশাসনিক বিবরণ

জেলায় রয়েছে ১৩টি উপজেলা, ৪টি পৌরসভা, ১০৬টি ইউনিয়ন, ৩২৪৯টি গ্রাম ও ২১০টি মহল্লা। সিলেট শহর ২৭টি ওয়ার্ডে বিভক্ত। জনসংখ্যা প্রায় ২.৮৫ লাখ, ঘনবসতি প্রতি বর্গ কিমিতে ২৭,২২৪ জন।

ঐতিহাসিক ঘটনাবলি ও আন্দোলন

নানকার বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে সিলেটের অবদান ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুনঃ জামালপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস

১৯২৭ সালে সিলেটের এম.এল.এ-গণ বাংলায় কথা বলার অধিকার আদায় করেন। ১৯৫০ সালে জমিদার প্রথার অবসানে নানকার বিদ্রোহের গুরুত্ব অপরিসীম।

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন

সিলেটের উল্লেখযোগ্য প্রত্নসম্পদের মধ্যে রয়েছে জৈন্তাপুরের প্রসত্মর স্মৃতি, গড়দুয়ার ঢিবি, গায়েবী মসজিদ, শাহজালাল (র.) ও শাহপরাণ (র.) দরগাহ, নবাবী মসজিদ, মুঘল মসজিদ, এবং তিন মন্দির।

শেষ কথা

সিলেট জেলার ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব একে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করেছে। সঠিকভাবে সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও পর্যটনের প্রসারে সিলেট ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিতে আরও বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button