টাঙ্গাইল জেলার নামকরণের ইতিহাস
টাঙ্গাইল বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা, যা তাঁতের শাড়ি, চমচম ও লোকজ সংস্কৃতির জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। জেলার নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা জনশ্রুতি।কেউ বলেন ‘টান’ ও ‘আইল’ শব্দের সংমিশ্রণে, আবার কেউ বলেন টেংগু সাহেবের তৈরি পথে বা মোপলা সম্প্রদায়ের ‘তাংগাইল’ শব্দ থেকে এ নামের উৎপত্তি।
ইতিহাস ও কল্পকথার মিলনে টাঙ্গাইল নামটি আজ একটি বিস্ময়কর সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ হয়ে উঠেছে।
টাঙ্গাইল জেলার নামকরণের ইতিহাস?
টাঙ্গাইল জেলার নামকরণ নিয়ে বহু মত ও জনশ্রুতি রয়েছে, যা এই অঞ্চলের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সাক্ষ্য বহন করে।
প্রারম্ভিক ইতিহাস
রেনেলের মানচিত্রে সমগ্র অঞ্চলটিকে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘আটিয়া’ নামে চিহ্নিত করা হয়। ১৮৬৬ সালের পূর্বে ‘টাঙ্গাইল’ নামে কোন স্বতন্ত্র স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায় না।
আটিয়া থেকে মহকুমা সদর দপ্তর ১৮৭০ সালের ১৫ নভেম্বর টাঙ্গাইলে স্থানান্তরের পর থেকেই ‘টাঙ্গাইল’ নামটি খুব পরিচিতি লাভ করে।
ভাষাগত উৎস
টাঙ্গাইলের একজন ইতিহাসবিদ খন্দকার আব্দুর রহিমের মতে, ইংরেজ আমলে স্থানীয়রা ‘উঁচু’ অর্থে ‘টান’ শব্দটি ব্যবহার করতো। ‘
টান’ ও কৃষিজমিতে ব্যবহৃত সীমানার নির্দেশক শব্দ ‘আইল’ একত্রে হয়ে ‘টান আইল’ এবং পরে ‘টাঙ্গাইল’ রূপে প্রচলিত হয়।
টেংগু সাহেবের আইল জনশ্রুতি
এক মতে, বৃটিশ শাসনের শুরুতে টেংগু নামের এক ইংরেজ নীলকর আকুরটাকুর ও শাহবালিয়া মৌজার মাঝে নীলচাষ করতেন।
তিনি একটি উঁচু আইল নির্মাণ করেন, যাকে স্থানীয়রা ‘টেংগু সাহেবের আইল’ বলত। সেই টেংগু-আইল থেকেই ‘টাঙ্গাইল’ শব্দটির উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন।
মোপলা বসতি তত্ত্ব
গবেষক খুররম হোসেনের মতে, সুবেদার শায়েস্তা খাঁ জলদস্যু দমনকল্পে দক্ষিণ ভারতের মোপলাদের এনে টাঙ্গাইল শহরের পশ্চিমাংশে বসতি গড়েন। তাদের ধর্মীয় নেতাকে তারা ‘তাংগাইল’ নামে ডাকত।
সেই স্থানটির নামই পরে ‘টাঙ্গাইল’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। এই মতের উল্লেখ টাঙ্গাইল জেলা গেজেটিয়ার ও আদমশুমারির রিপোর্টেও রয়েছে।
‘টাঙ্গা’ ও ‘আইল’ সংযুক্তি তত্ত্ব
বৃটিশ শাসনামলে ঘোড়ার গাড়ি, যাকে স্থানীয়ভাবে ‘টাঙ্গা’ বলা হতো, এ অঞ্চলে বহুল ব্যবহৃত ছিল। আবার ‘আইল’ মানে জমির সীমারেখা বা উঁচু পাথ। এই দুটি শব্দ থেকে ‘টাঙ্গাইল’ নামটি গঠিত হয়েছে বলে একটি জনশ্রুতি প্রচলিত।
ইতিহাসবিদ মুফাখখারুল ইসলামের মত
তিনি মনে করেন, কাগমারি জমিদার ইনাযাতুল্লাহ খাঁ লৌহজং নদীর পাড় দিয়ে যাতায়াত করতেন এক ধরনের উঁচু পথ বা ‘টানের আইল’ দিয়ে। এই পথের নাম থেকেই ‘টাঙ্গাইল’ নামটি এসেছে।
ধর্মীয় ও আঞ্চলিক প্রভাব
আরও একটি মতে, হযরত শাহ জামাল (রহঃ) জাহাজযোগে মাদ্রাজ থেকে জেলেদের নিয়ে এসেছিলেন। তাদের নেতা ছিলেন ‘টাংগা’ নামক একজন, যার নামানুসারে টাঙ্গাইল নামটি এসেছে।
এছাড়া ‘টং’ (ফরাসি শব্দ; অর্থ: উঁচু) ও ‘ইল’ (অর্থ: বসবাসস্থান) শব্দদ্বয়ের সংযোগেও টাঙ্গাইল নামের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা হয়।
আরও কিছু মত
কেউ কেউ মনে করেন, এক ইংরেজ টাঙ্গিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন বলেই এই জায়গার নাম হয় ‘টাঙ্গাইল’। আবার ‘টান’ ও ‘ইল’ নামে দুইজন ইংরেজ কর্মকর্তার নামের সম্মিলনেও এই নামকরণ ঘটেছে বলে ধারণা রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ মেহেরপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস
আইল শব্দের আধিক্য
টাঙ্গাইল জেলার অন্যান্য অনেক স্থান যেমন বাসাইল, ঘাটাইল, ডুবাইল, নিকরাইল, রামাইল ইত্যাদিতে ‘আইল’ শব্দের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এ থেকেই বোঝা যায়, ‘আইল’ শব্দটি এ অঞ্চলের নামকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
টাঙ্গাইল ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার একটি মহকুমা ছিল। ঐ বছরেই এটি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। নদী বিধৌত এই কৃষিপ্রধান অঞ্চলটি বাংলাদেশের অন্যতম উর্বর ভূমি হিসেবে পরিচিত।
জেলার পশ্চিম সীমান্ত ঘেঁষে প্রবাহিত হয়েছে প্রমত্তা যমুনা নদী এবং এর অভ্যন্তর দিয়ে বয়ে গেছে লৌহজং নদী, যা টাঙ্গাইলের ভূপ্রকৃতি ও কৃষিকাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।