পড়াশোনা

ফরিদপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস

ফরিদপুর বাংলাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী একটি জেলা, যার নামকরণের পেছনে রয়েছে ইতিহাস ও ধর্মীয় প্রভাবের মিলন। ধারণা করা হয়, সুফি সাধক শাহ ফরিদ উদ্দিনের নাম অনুসারে এ জেলার নামকরণ হয় ‘ফরিদপুর’।ফরিদপুর জেলার নামকরণের ইতিহাসমোগল আমলে তাঁর ধর্মপ্রচারের প্রভাব এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, এলাকাটি তাঁর নামেই পরিচিতি পেতে থাকে। ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের ধারায় ফরিদপুর নামটি আজো বহন করে এক গৌরবময় পরিচয়।

ফরিদপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস?

ফরিদপুর জেলার নামকরণের পেছনে রয়েছে একটি গভীর ইতিহাস ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপট। প্রাচীনকালে এই অঞ্চল “ফতেহাবাদ” নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে, এই জেলার নামকরণ করা হয় “ফরিদপুর”

প্রখ্যাত সুফি সাধক ও দরবেশ শাহ ফরিদ (পূর্ণনামঃ শেখ ফরিদুদ্দিন) এর স্মরণে। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি সাধক খাজা মাইনউদ্দিন চিশতীর একজন বিশিষ্ট শিষ্য

এবং ফরিদপুর অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ও মানবিকতা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর আধ্যাত্মিক প্রভাব ও জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই অঞ্চলের নাম ফরিদপুর রাখা হয়।

প্রশাসনিক উন্নয়ন

১৭৮৬ সালে (মতান্তরে ১৮১৫) ফরিদপুর জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতে এর নাম ছিল জালালপুর এবং সদরদপ্তর ছিল ঢাকায়।

সে সময় বর্তমান ফরিদপুর অঞ্চলকে ডাকা হতো ফতেহাবাদ নামে। ১৮০৭ সালে জেলার সদর দপ্তর ফরিদপুরে স্থানান্তর করা হয়। এরপর ১৮২৫ সালে ফরিদপুর কারাগার প্রতিষ্ঠিত হয়।

শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান

১৮৪০ সালে তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এডগার এফ. লুথার ‘ইংলিশ সেমিনারি স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা ১৮৫১ সালে ফরিদপুর জিলা স্কুল নামে আত্মপ্রকাশ করে। ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফরিদপুর পৌরসভা,

যা তৎকালীন সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও নাগরিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফরিদপুর টাউন থিয়েটার (বর্তমানে বন্ধ)।

এই সময়ে চৌধুরী ময়েজউদ্দিন বিশ্বাস ফরিদপুরের একজন প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন, যিনি ১৮৮৫ সালে ময়েজ মঞ্জিল নির্মাণ করেন। একই সময়ে নির্মিত হয় ফরিদপুর জজ কোর্ট ভবন।

১৮৮৯ সালে ফরিদপুর জিলা স্কুলের পশ্চিম পাশে ফরিদপুর উচ্চ বিদ্যালয় এবং বর্তমান দক্ষিণ ঝিলটুলিতে হিতৈষী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৮৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফরিদপুর কোতয়ালী থানা।

যোগাযোগ ও অবকাঠামো

১৮৯৯ সালে কুষ্টিয়া গোয়ালন্দ ঘাট রেললাইন নির্মাণের অংশ হিসেবে পাচুরিয়া জংশন হতে পুখুরিয়া পর্যন্ত রেলপথ তৈরি করা হয় এবং ফরিদপুর রেলওয়ে স্টেশন স্থাপন করা হয়।

স্বাস্থ্য ও উচ্চশিক্ষা

১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফরিদপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, এবং ১৯১৭ সালে নির্মিত হয় ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতাল।

১৯১৮ সালে অম্বিকাচরণ মজুমদার প্রতিষ্ঠা করেন রাজেন্দ্র কলেজ, যা ফরিদপুরে উচ্চশিক্ষার প্রসারে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি

১৯২১ সালে নির্মিত হয় ফরিদপুর টাউন হল, যা পরবর্তীতে অম্বিকাচরণ মজুমদারের নামানুসারে অম্বিকা মেমোরিয়াল হল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

১৯২৭ সালে ফরিদপুর আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং ১৯৩২ সালে হালিমা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাণিজ্য ও অবকাঠামো

ব্রিটিশ আমলে ফরিদপুরের বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল বর্তমানের চকবাজার ও রথখোলা এলাকা, যা কুমার নদীর দুই তীরে অবস্থিত। নদীর দুই পাড়কে সংযুক্ত করতে ১৯৩৫ সালে আলিমুজ্জামান সেতু নির্মিত হয়, যা বর্তমানে ‘বেইলি ব্রিজ’ নামে পরিচিত।

১৯৩৬ সালে তৎকালীন ফরিদপুর জজ কোর্টের বিচারক মৌলভি তমিজউদ্দিন খান পুরাতন কোর্ট জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন।

আরও পড়ুনঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস

পূর্ব-পাকিস্তান আমল

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমেদ ফরিদপুর কারাগারে বন্দি ছিলেন। এটি ফরিদপুরের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়।

খেলাধুলা ও কারিগরি শিক্ষা

১৯৫৬ সালে ফরিদপুর স্টেডিয়াম নির্মিত হয়। ১৯৬৩ সালে ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ১৯৬৬ সালে ফরিদপুর গভঃ কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট ও সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজ এবং ১৯৬৮ সালে ইয়াছিন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা শিক্ষা ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button