পড়াশোনা

গোপালগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত গোপালগঞ্জ জেলা একটি প্রাচীন জনপদ, যার ইতিহাস ও সংস্কৃতি বহুমাত্রিক। এ জেলার নামকরণের পেছনে রয়েছে নানা মত, উপাখ্যান ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। “গোপালগঞ্জ” নামটি কীভাবে সৃষ্টি হলো?গোপালগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাসতা জানার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হয় অতীতের সামাজিক, ধর্মীয় ও ভৌগোলিক পরিবেশে। এই আর্টিকেলে আমরা গোপালগঞ্জ নামের উৎপত্তি, ঐতিহাসিক সূত্র এবং জনশ্রুতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে নামকরণের প্রকৃত পটভূমি অনুসন্ধান করার চেষ্টা করব।

গোপালগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস?

গোপালগঞ্জ অঞ্চলটি এক সময় মাকিমপুর স্টেটের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং এর জমিদারি দায়িত্বে ছিলেন বিখ্যাত নারী নেতৃত্বের প্রতীক রানী রাসমনি। তিনি জন্মেছিলেন এক জেলে পরিবারে

কিন্তু তার অসাধারণ সাহসিকতা ও মানবিক গুণাবলীর কারণে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। সিপাহি বিদ্রোহের সময় রানী রাসমনির এক সাহসিক পদক্ষেপ তাকে বিশেষ মর্যাদায় উন্নীত করে।

একদিন, বিদ্রোহ চলাকালে তিনি এক ইংরেজ সাহেবের প্রাণ রক্ষা করেন। এই ঘটনার ফলস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাকে সম্পূর্ণ মাকিমপুর অঞ্চল উপহার স্বরূপ প্রদান করে।

রানী রাসমনির নাতি গোপাল ছিলেন এই অঞ্চলের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি। ধারণা করা হয়, তার নামানুসারেই রাজগঞ্জ এলাকার নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘গোপালগঞ্জ’ নাম ধারণ করে।

১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার জ্ঞানবাজার নিবাসী প্রীতিরাম দাস বর্তমান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার অন্তর্গত অনুর্বর ও অসমতল মকিমপুর পরগনায় জমিদারি ক্রয় করেন। তিনি তৎকালীন সময়ের ১৯ হাজার টাকার বিনিময়ে এই জমিদারির মালিক হন।

১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে এপ্রিল তার দ্বিতীয় পুত্র রাজচন্দ্র দাস মাহিষ্য বংশীয় কন্যা রাসমনিকে বিবাহ করেন। রাজচন্দ্র দাস ছিলেন প্রীতিরাম দাসের জমিদারির উত্তরাধিকারী ও একজন প্রভাবশালী জমিদার।

১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুন, মাত্র ৪৯ বছর বয়সে রাজচন্দ্র দাস মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান স্ত্রী রানী রাসমনি ও তাঁদের চার কন্যাকে। তাদের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না।

রাজচন্দ্র ও রাসমনির জ্যেষ্ঠ কন্যা পদ্মমনির বিবাহ হয় রামচন্দ্রের সঙ্গে। এই দম্পতির সাত সন্তান ছিল: মহেন্দ্র নাথ, গনেশচন্দ্র, সৌদামিনী, সুভদ্রা, বলরাম, কালী এবং সতীনাথ।

বড় পুত্র মহেন্দ্র নাথ শৈশবেই মৃত্যুবরণ করেন। ফলে জীবিত পুত্রদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ গনেশচন্দ্র জমিদার হন। রানী রাসমনির মহত্ব ও উদারতার প্রতি সম্মান জানিয়ে খাটরা এস্টেটের প্রজারা স্থানীয় রাজগঞ্জ বাজারের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব দেন।

রানীর নাতি তথা গনেশচন্দ্রের একমাত্র পুত্র নব গোপালের নামানুসারে নতুন নামকরণ করা হয়। এখানে “নব গোপাল”-এর “গোপাল” এবং “রাজগঞ্জ” এর “গঞ্জ” অংশ একত্র করে এই বাজার ও পরবর্তী সময়ে গোটা অঞ্চলের নামকরণ হয় “গোপালগঞ্জ”।

মধুমতি নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে আজকের গোপালগঞ্জ শহর। প্রাচীনকালে এ অঞ্চল বঙ্গ রাজ্যের অংশ ছিল। সুলতানী ও মুঘল আমলে এই অঞ্চল হিন্দু রাজাদের অধীনে শাসিত হতো।

ব্রিটিশ শাসনামলে প্রশাসনিক পরিবর্তন

১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর এলাকা যশোর জেলার অন্তর্গত ছিল এবং বাকি অঞ্চল ছিল ঢাকা-জালালপুর জেলার অংশ।

১৮০৭ সালে মুকসুদপুর থানা যশোর জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ফরিদপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত হয়। ফরিদপুর জেলার একটি পরগনার নাম ছিল ‘জালালপুর’, যার অন্তর্গত ছিল গোপালগঞ্জ সদর ও কোটালীপাড়া।

১৮১২ সালে চান্দনা (মধুমতি) নদী যশোর ও ঢাকা-জালালপুর জেলার মধ্যবর্তী সীমারেখা হিসেবে নির্ধারিত হয়। সেই সময়ে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর অঞ্চল ছিল বিস্তৃত জলাভূমি অঞ্চল

এবং নৌ-ডাকাতির জন্য কুখ্যাত ছিল। ফলে, প্রশাসনিক প্রয়োজনে ১৮৫৪ সালে বাকেরগঞ্জ জেলা থেকে বিভক্ত হয়ে ‘মাদারীপুর মহকুমা’ গঠিত হয়।

থানা ও মহকুমা গঠনের ধারা

১৮৭২ সালে গোপালগঞ্জ নামক একটি থানা গঠিত হয় মাদারীপুর মহকুমার অধীনে। ১৮৭৩ সালে মাদারীপুর মহকুমাকে বাকেরগঞ্জ জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফরিদপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

১৯০৯ সালে মাদারীপুর মহকুমা ভেঙে গঠিত হয় ‘গোপালগঞ্জ মহকুমা’। গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়া থানার পাশাপাশি ফরিদপুর মহকুমার মুকসুদপুর থানাও নতুন গোপালগঞ্জ মহকুমায় যুক্ত হয়। গোপালগঞ্জ মহকুমার প্রথম প্রশাসক ছিলেন জনাব সুরেশ চন্দ্র সেন।

১৯১০ সালে মহকুমা প্রশাসকের বেঞ্চ কোর্টকে ফৌজদারি কোর্টে উন্নীত করা হয়। ১৯২১ সালে গোপালগঞ্জ শহরের মান বৃদ্ধি পায় এবং তখনকার আদমশুমারি অনুযায়ী শহরের জনসংখ্যা ছিল ৩,৪৭৮ জন। ১৯২৫ সালে গোপালগঞ্জে সিভিল কোর্ট চালু করা হয়।

আরও পড়ুনঃ পটুয়াখালী জেলার নামকরণের ইতিহাস

পরবর্তী প্রশাসনিক উন্নয়ন

  • ১৯৩৬ সালে মুকসুদপুর থানা বিভক্ত হয়ে নতুন কাশিয়ানী থানা গঠিত হয়।
  • ১৯৭৪ সালে গোপালগঞ্জ সদর থানা বিভক্ত হয়ে টুঙ্গিপাড়া থানা গঠিত হয়।

১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, গোপালগঞ্জ মহকুমাকে পূর্ণ জেলা হিসেবে উন্নীত করা হয়। জেলার প্রথম প্রশাসক ছিলেন জনাব এ. এফ. এম. এহিয়া চৌধুরী।

বর্তমান প্রশাসন

বর্তমান জেলা প্রশাসক জনাব কাজী মাহবুবুল আলম, যিনি ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর থেকে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button