পড়াশোনা

মাদারীপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস

মাদারীপুর বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ভরপুর জেলা। এর নামকরণ ঘিরে রয়েছে একটি বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। মাদারীপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস

সুফি সাধক হযরত বাদশা মিয়া (রহঃ), যিনি ‘মাদার পীর’ নামে পরিচিত ছিলেন, তাঁর স্মৃতিকে কেন্দ্র করেই জেলার নাম ‘মাদারীপুর’ রাখা হয়।

এই ভূমি ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় বহন করে চলেছে আজও। আজকের আর্টিকেলে মাদারীপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

মাদারীপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস?

মাদারীপুর জেলার নামকরণ ইতিহাস ও ধর্মীয় ঐতিহ্যে ভরপুর। এই অঞ্চলের নামকরণ সম্পৃক্ত এক প্রখ্যাত সুফি সাধক কুতুব-ই-জাহান হযরত বদিউদ্দীন আহমেদ জিন্দা শাহ মাদার (রহ.)-এর স্মৃতির সঙ্গে।

তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সিরিয়া থেকে চতুর্দশ শতাব্দীতে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের (১৩৫১–১৩৮৮ খ্রি.) শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করেন। বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের অংশ হিসেবে তিনি বাংলার বহু স্থানে সফর করেন।

তৎকালীন চন্দ্রদ্বীপ (বর্তমান বরিশাল) অঞ্চলের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত একটি গভীর অরণ্যে ভ্রমণের সময় তিনি ও তাঁর সহযাত্রীরা কিছু সময় বিশ্রাম নেন। পরবর্তীকালে ঐ স্থানে তাঁর স্মৃতিকে সম্মান জানাতে একটি দরগাহ শরীফ নির্মাণ করা হয়।

সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বিক্রমপুরের এক জমিদার ওই অঞ্চলকে ঘিরে ভূমিহীন প্রজাদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি এলাকাটিকে ‘মাদারণ’ বা ‘মাদারণ অঞ্চল’ নামে আখ্যায়িত করে সেখানে কৃষিজমি ও বসতি গড়ে তোলেন।

সেই মাদারণই ধীরে ধীরে গ্রাম-ইউনিয়ন হিসেবে পরিচিতি পায়। পরবর্তী সময়ে শহরায়নের প্রক্রিয়ায় ‘মাদারণ’ নামটি বিবর্তিত হয়ে ‘মাদারীপুর’ নাম ধারণ করে, যা আজকের মাদারীপুর জেলার পরিচয় হয়ে উঠেছে।

প্রাচীন ইতিহাস

মাদারীপুরের প্রাচীন নাম ছিল ‘ইদিলপুর’। এটি চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের একটি সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল। সেই সময়ের প্রশাসনিক নাম ছিল ‘নাব্যমণ্ডল’। কোটালীপাড়া ছিল বাংলা সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র,

যা খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকেই বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বে আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানকালীন কালে এখানে গঙ্গারিডি জাতি স্বাধীনভাবে রাজত্ব করত।

৩২০-৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চল ছিল গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীন। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর ‘মাৎস্যায়ন যুগ’ নামে পরিচিত একশ বছরের বিশৃঙ্খলা পেরিয়ে পাল বংশ (৭৫০-১২২৪ খ্রিঃ) এ অঞ্চল শাসন করে। চন্দ্রবংশ ও সেন রাজারা পরবর্তীতে এখানে শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

চন্দ্র বংশের শাসক শ্রীচন্দ্রের তাম্রশাসন ইদিলপুর ও কেদারপুরে পাওয়া গেছে। সেন যুগে মদনপাড়া ও কোটালীপাড়ায় তাদের শাসনের চিহ্ন রয়েছে। পরবর্তীতে এই অঞ্চল চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

সুলতানি ও মুঘল আমল

১২০৩ থেকে ১৫৭৫ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চল সুলতানদের শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রুকনউদ্দীন বরবক শাহ ও জালালউদ্দীন ফতেহ শাহ ফরিদপুর ও চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চল দখল করে ‘ফতেহাবাদ’ নামে একটি পরগনা গঠন করেন, যা মাদারীপুরের ঐতিহাসিক নাম।

সুলতান হুসেন শাহ এই অঞ্চলের একজন জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। এরপর শেরশাহ, কররানি ও বারভূঁইয়া শাসকদের হাত ঘুরে অবশেষে মোগল ও নবাবদের শাসন শুরু হয়, যা ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।

ইংরেজ শাসনামল

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা ঘটে এবং ১৭৬৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তারা শাসন করে। ১৮৫৪ সালে মাদারীপুর মহকুমা হিসেবে প্রশাসনিক স্বীকৃতি লাভ করে।

এ সময় মাদারীপুর ছিল বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু। ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা হাজি শরীয়ত উল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০) এবং তাঁর পুত্র দুদু মিয়া (১৮১৯-১৮৬২) এই জেলার গর্ব।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চিত্তপ্রিয় রায় চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত এবং অম্বিকাচরণ মজুমদারের নাম স্মরণীয়।

পাকিস্তান আমল

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনের পর পূর্ব বাংলার জনগণ শোষণ ও বৈষম্যের শিকার হয়। ভাষা আন্দোলন (১৯৫২)

যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন (১৯৫৪), গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯) এবং মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১) সহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মাদারীপুরবাসীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।

আরও পড়ুনঃ মৌলভীবাজার জেলার নামকরণের ইতিহাস

স্বাধীন বাংলাদেশ ও জেলা প্রশাসনের সূচনা

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর জেলার অনেক মানুষ শহিদ হন। ১৮৫৪ সালে মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটে ১৯৮৪ সালে

যখন মাদারীপুর জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। নবীন এই জেলা প্রশাসন আজ জনগণের দোরগোড়ায় সরকারি সেবা পৌঁছে দিতে সচেষ্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button