পড়াশোনা

রাজবাড়ী জেলার নামকরণের ইতিহাস

বাংলাদেশের অন্যতম ঐতিহাসিক জেলা রাজবাড়ীর নামকরণ হয়েছে এখানে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রভাবশালী জমিদার পরিবারের রাজপ্রাসাদ বা “রাজবাড়ী” থেকে।রাজবাড়ী জেলার নামকরণের ইতিহাসকথিত আছে, নাটোর রাজপরিবারের শাখা হিসেবে রাজা সূর্যকান্ত ও তাঁর উত্তরসূরিদের এই অঞ্চলে রাজবাড়ী স্থাপন ও শাসনকার্য পরিচালনার ফলে এলাকাটি “রাজবাড়ী” নামে পরিচিতি লাভ করে।

পরবর্তীতে প্রশাসনিকভাবে এ অঞ্চলের নাম “রাজবাড়ী জেলা” হিসেবে স্বীকৃত হয়। এই নামের পেছনে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বিদ্যমান। যা আজও জেলা পরিচয়ের প্রধান অংশ হিসেবে বিবেচিত।

রাজবাড়ী জেলার নামকরণের ইতিহাস?

রাজবাড়ী জেলার নামকরণ নিয়ে প্রচলিত মতভেদ থাকলেও অধিকাংশ ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে একটি বিষয়ে স্পষ্ট সম্মতি পাওয়া যায় যে, এ জেলার নাম ‘রাজবাড়ী’ এসেছে কোনো এক রাজার বা জমিদারের প্রভাবশালী উপস্থিতির কারণে।

যদিও অনেকেই রাজা সূর্য্য কুমারের নামানুসারে রাজবাড়ী নামকরণ হয়েছে বলে বিশ্বাস করেন। তবে ঐতিহাসিকভাবে নামকরণের নির্ভরযোগ্য দলিল অপ্রতুল।

প্রাচীনকালে পদ্মা, হড়াই, গড়াই, চন্দনা, কুমার ও চত্রা নদীবাহিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত বর্তমান রাজবাড়ী ছিল একসময় ‘বাংলার প্রবেশদ্বার’ নামে খ্যাত গোয়ালন্দ মহকুমা। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ গোয়ালন্দ মহকুমাকে রাজবাড়ী জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃক ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত এল.এন. মিশ্রের বাংলার রেল ভ্রমণ নামক পুস্তকে উল্লেখ করা হয় যে, ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার সুবাদার নবাব শায়েস্তা খান পর্তুগিজ জলদস্যু দমনে সংগ্রাম শাহকে নাওয়ারা প্রধান করে এই অঞ্চলে প্রেরণ করেন।

এ সময় সংগ্রাম শাহ বানিবহতে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। এবং তিনি লালগোলা নামে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। আর এই লালগোলা দুর্গই বর্তমান রাজবাড়ী শহরের উত্তরে অবস্থিত লালগোলা গ্রাম।

পরবর্তীতে সংগ্রাম শাহ ও তার বংশধররা নাওয়ারা চৌধুরী নামে পরিচিতি লাভ করেন। এবং তাদের বসতবাড়ি স্থানীয়ভাবে ‘রাজবাড়ী’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এ অঞ্চলে রেলওয়ে স্টেশন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯০ সালে।

এল.এন. মিশ্রের পুস্তকের অন্তিম পাতায় “রাজবাড়ী” নামটি রেল স্টেশন হিসেবে উল্লেখ পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক আনন্দনাথ রায় তার ফরিদপুর জেলার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন,

নাওয়ারা চৌধুরীগণ পাঁচথুপি থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে বানিবহে এসে বসবাস শুরু করেন। এবং তাদের বাসস্থানই ‘রাজবাড়ী’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে একটি প্রচলিত মত অনুসারে রাজবাড়ীর নামকরণ হয়েছে রাজা সূর্য কুমারের নাম অনুসারে।

তার পিতামহ প্রভুরাম নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার রাজকর্মচারী ছিলেন। এবং পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজদের বিরাগভাজন হয়ে লক্ষীকোলে আত্মগোপন করেন। পরে তার পুত্র দ্বিগেন্দ্র প্রসাদ জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন।

এবং তারই পুত্র সূর্য কুমার ১৮৮৫ সালে জনহিতকর কর্মকাণ্ডের জন্য ‘রাজা’ উপাধি লাভ করেন। তখনই রাজবাড়ী রেল স্টেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং সেটির নামকরণ নিয়ে সূর্য কুমারের নাম প্রস্তাব করা হলে, বানিবহের জমিদারগণ আপত্তি জানান।

কারণ, রেল স্টেশন স্থাপনের জমি ছিল তাদের মালিকানাধীন। জমিদারদের আপত্তির ফলেই “রাজবাড়ী” নামটি অপরিবর্তিত থাকে, যা পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল।

এই সকল তথ্য ও দলিল পর্যালোচনা করে বলা যায় যে, রাজবাড়ী নামটির উৎপত্তি একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তির নামানুসারে নয় বরং ঐ অঞ্চলের শক্তিশালী জমিদার পরিবার,

নাওয়ারা চৌধুরীদের প্রভাব ও লোকমুখে প্রচলিত ‘রাজার বাড়ি’ শব্দের ধারাবাহিকতায় হয়ে থাকতে পারে। পরবর্তীকালে রাজা সূর্য কুমার ও তার বংশধরেরা এ নামকে আরও জনপ্রিয় করে তোলেন।

বর্তমান রাজবাড়ী জেলা দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জেলার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইংরেজরা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করার পর ১৭৬৫ সালে রাজবাড়ী জেলার উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল রাজশাহী অঞ্চলের জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত ছিল।

সেই সময় নাটোর রাজার জমিদারীর অধীনস্থ ছিল এই অঞ্চল। যার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আজও রাজবাড়ী জেলার বেলগাছিতে স্নানমঞ্চ ও দোলমঞ্চ বিদ্যমান। পরবর্তীতে এই এলাকা যশোর জেলার অংশ হয়।

ফরিদপুর জেলা ১৮১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হলে রাজবাড়ীকে ফরিদপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে রাজবাড়ী জেলার বর্তমান উপজেলাগুলোর ইতিহাস ভিন্ন ভিন্ন জেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল।

  • পাংশা থানা এক সময় পাবনা জেলার অংশ ছিল।
  • পাংশা ও বালিয়াকান্দিকে ১৮৫৯ সালে নবগঠিত কুমারখালী মহকুমার অধীনে নেওয়া হয়।
  • গোয়ালন্দ মহকুমা ১৮৭১ সালে গঠিত হলে পাংশা এবং রাজবাড়ী এই নতুন মহকুমার সঙ্গে যুক্ত হয়।
  • এবং রাজবাড়ীকে মহকুমা সদর হিসেবে স্থাপন করা হয়।
  • ঢাকা জালালপুর হেড কোয়ার্টার ফরিদপুরে স্থানান্তর হলে ১৮০৭ সালে পাংশা থানা ফরিদপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়।
  • লর্ড ডালহৌসির সময় ঢাকা ও জালালপুর ভেঙ্গে ফরিদপুর জেলা গঠিত হলে।
  • ১৮৫০ সালে গোয়ালন্দ ফরিদপুরের অধীনে চলে যায়।
  • তবে পাংশা ও বালিয়াকান্দি তখনও পাবনা জেলার অধীনেই ছিল।

আধুনিক প্রশাসনিক রূপান্তর

১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নীতির আওতায় প্রতিটি থানাকে “মান উন্নীত থানা”তে রূপান্তরিত করে। এরই অংশ হিসেবে রাজবাড়ীকে মান উন্নীত থানা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালের ১৮ জুলাই একটি সরকারী অধ্যাদেশ জারি করে মান উন্নীত সকল থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয়, ফলে রাজবাড়ী উপজেলায় রূপান্তরিত হয়।

এরপর গোয়ালন্দ মহকুমার সদর দপ্তর রাজবাড়ীতে থাকায়, ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ বাংলাদেশ সরকার সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করলে রাজবাড়ী জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সেই থেকে রাজবাড়ী একটি পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button