চট্টগ্রাম জেলার নামকরণের ইতিহাস
চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক জেলা, যার নামকরণের পেছনে রয়েছে বহু মত ও ব্যাখ্যা। প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলটি বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী হিসেবে পরিচিত ছিল।
আরব, পারস্য, চীনসহ বহু বিদেশি নাবিক ও বণিকগণ এই স্থানে আগমন করে এর ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, জনপদ এবং সাংস্কৃতিক সম্পদের বিবরণ দিয়েছেন। চট্টগ্রাম নামটি কোথা থেকে এসেছে তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।কেউ কেউ মনে করেন “চট্টলা” বা “চট্টগাঁও” শব্দ থেকে এর উদ্ভব, আবার অনেকে বলেন সংস্কৃত “চতুঃগ্রাম” (চার গ্রাম) শব্দের অপভ্রংশ থেকেই চট্টগ্রাম নামটির সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়াও স্থানীয় উপকথা, আরব ভ্রমণকারীদের বিবরণ, এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের আলোকে এই নামকরণকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই আর্টিকেলে আমরা চট্টগ্রাম জেলার নামকরণের ইতিহাস?
ও এর সাথে জড়িত বিভিন্ন মতামত, কিংবদন্তি ও ঐতিহাসিক সূত্র বিশ্লেষণ করে উপস্থাপন করবো, যাতে এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈচিত্র্য সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম জেলার নামকরণের ইতিহাস?
চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক জনপদ, যার রয়েছে বহুপ্রাচীন নাম ও সমৃদ্ধ ইতিহাস। গবেষকদের মতে, এ জেলার মোট প্রায় ৪৮টি ভিন্ন নামের খোঁজ পাওয়া গেছে।
এ নামগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রম্যভূমি, চাটিগাঁ, চাতগাঁও, রোসাং, চিতাগঞ্জ, জাটিগ্রাম ইত্যাদি। চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি নিয়ে গবেষকদের মধ্যে নানা মতভেদ রয়েছে।
পণ্ডিত বার্নোলির মতে, আরবি শব্দ “শ্যাত” অর্থাৎ ‘খণ্ড’ বা বদ্বীপ এবং “গাঙ্গ” অর্থ গঙ্গা নদী এই দুটি শব্দ মিলিয়েই “চট্টগ্রাম” নামের উদ্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
অন্য এক প্রচলিত মত অনুযায়ী, ত্রয়োদশ শতকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বারোজন আউলিয়া এই অঞ্চলে আগমন করেন। তারা ইসলাম প্রচারের জন্য একটি বড় চেরাগ বা বাতি জ্বালিয়ে একটি উঁচু স্থানে স্থাপন করেন।
স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় ‘চাটি’ অর্থ বাতি বা চেরাগ এবং ‘গাঁও’ অর্থ গ্রাম। এ থেকেই চাটিগাঁও নামটি প্রচলিত হয়, যা পরবর্তীতে চট্টগ্রামে রূপান্তরিত হয়। এছাড়াও এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোন্স মনে করেন,
এই এলাকার একটি ক্ষুদ্র পাখির নাম থেকেই চট্টগ্রাম নামের উদ্ভব হয়েছে। চট্টগ্রাম ইতিহাসের ধারায় বিভিন্ন শাসকের অধীনে আসে। ১৬৬৬ সালে মুঘলরা আরাকানীদের পরাজিত করে এই অঞ্চল দখল করে নেয়
এবং এর নামকরণ করে ইসলামাবাদ। মুঘল শাসনামলে এর প্রশাসনিক সীমানা নির্ধারিত হয় এবং এটি মুঘল সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়।
১৭৬০ সালে পরবর্তীতে নবাব মীর কাশিম আলী খান এই অঞ্চলটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করেন। ব্রিটিশ শাসনামলে এই এলাকার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘চিটাগাং’।
চট্টগ্রামের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস
খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দী থেকেই আরব বণিকগণ চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে ১৫৫২ সালে বিখ্যাত পর্তুগিজ ঐতিহাসিক ডি বারোস চট্টগ্রামকে বাংলা রাজ্যের সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ও সম্পদশালী নগরী হিসেবে বর্ণনা করেন, যেখানে পূর্বাঞ্চলের সকল বাণিজ্য জাহাজ এসে ভিড় করত।
বর্মি ঘটনাপঞ্জিতে উল্লেখিত তথ্য মতে, ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে চট্টগ্রাম আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই সময়ের রাজারা সাধারণত “চন্দ্র” উপাধি ব্যবহার করতেন।
তিব্বতি ঐতিহ্যানুসারে, চট্টগ্রাম ছিল দশম শতাব্দীতে খ্যাতনামা বৌদ্ধ তান্ত্রিক তিলযোগীর জন্মস্থান। ঐতিহাসিক লামা তারনাথও গোপীচন্দ্র নামে এক বৌদ্ধ রাজার কথা উল্লেখ করেন, যাঁর রাজধানী ছিল চট্টগ্রামে।
মুসলিম শাসন ও প্রশাসনিক বিকাশ
দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক বাংলাকে তিনটি প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করেন লখনৌতি, সাতগাঁও ও সোনারগাঁও। ১৩৩৮ সালে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ সোনারগাঁওয়ের ক্ষমতা দখল করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই চট্টগ্রামও দখল করেন।
তিনি চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি মহাসড়ক নির্মাণের পাশাপাশি চট্টগ্রামে একাধিক মসজিদ ও সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন।
পর্তুগিজ আক্রমণ ও মগ দস্যুদের দৌরাত্ম্য
১৫৩৮ সালে সুলতান গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ-এর পতনের পর থেকে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত সময়কালে পর্তুগিজরা চট্টগ্রামে ঘন ঘন আক্রমণ চালায় এবং এ সময় চট্টগ্রাম তাদের কার্যত শাসনাধীন ছিল।
মগ জলদস্যুদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তারা দীর্ঘ ১২৮ বছর চট্টগ্রামকে লুণ্ঠনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত করে। তবে এ সময় বন্দরনগরী হিসেবে চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক খ্যাতি বৃদ্ধি পায়।
মুঘল বিজয় ও শান্তির প্রত্যাবর্তন
১৬৬৬ সালে মুঘল সেনাপতি মীর জুমলা ও শায়েস্তা খানের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী চট্টগ্রাম বিজয় করে। এর ফলে এ অঞ্চলে বিশেষত নগরীতে শান্তি-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। পর্তুগিজ শাসনের অবসানের মাধ্যমে বন্দর নগরী হিসেবে চট্টগ্রামের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়।
ব্রিটিশ শাসন ও আধুনিক চট্টগ্রামের বিকাশ
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের ফলে কলকাতার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় এবং এর ফলে চট্টগ্রামের প্রাধান্য কিছুটা হ্রাস পায়।
তবে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠিত হলে চট্টগ্রাম পুনরায় গুরুত্ব লাভ করে। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে নির্মাণের ফলে চট্টগ্রাম বন্দর ও এর পশ্চাদভূমির মধ্যে যোগাযোগ উন্নত হয়, যা চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
সিপাহি বিদ্রোহ ও চট্টগ্রাম
সিপাহি বিদ্রোহের সময় ৩৪তম বেঙ্গল পদাতিক রেজিমেন্টের ২য়, ৩য় ও ৪র্থ কোম্পানি ১৮৫৭ সালে চট্টগ্রামে অবস্থান করেছিল। ১৮ নভেম্বর রাতে তারা বিদ্রোহ করে ও জেলখানা ভেঙে বন্দীদের মুক্ত করেন।
তারা সরকারি হাতি, গোলাবারুদ ও সম্পদ নিয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে সিলেট ও কাছাড়ের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু কুকি স্কাউটস ও পরে পরিচিত দশম গোর্খা রাইফেল বাহিনীর হাতে বিদ্রোহীরা নিহত বা বন্দী হয়।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন ও বিপ্লব
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ৭০ জন যুবক চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার, গোলাবারুদের ভাণ্ডার ও টেলিফোন অফিসে একযোগে আক্রমণ চালায়।
ধুম এলাকায় রেললাইনের ফিসপ্লেট খুলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। একই সময়ে বিপ্লবী নারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে ধ্বংস করেন।
ফেরার পথে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। মাস্টারদা সূর্য সেন পরবর্তীতে গ্রেফতার হন এবং ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চট্টগ্রাম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা চট্টগ্রামকে একটি কৌশলগত ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে এটি জাপানি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
আরও পড়ুনঃ গোপালগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস
এপ্রিল মাসে ১৯৪২ সালের পতেঙ্গা বিমানঘাঁটিতে পরপর ২ দিন এবং ২০ ও ২৪ ডিসেম্বর পুনরায় বোমাবর্ষণ করা হয়।
প্রশাসনিক ইতিহাস
চট্টগ্রাম জেলার প্রশাসনিক ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৬৬৬ সালে, যখন মুঘল সাম্রাজ্য অঞ্চলটি আরাকানদের কাছ থেকে দখল করে নেয়। প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রাম জেলার অধীনে পার্বত্য অঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ এলাকা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পরবর্তীতে, ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা আলাদা করে গঠন করা হয়। আরও পরে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের অংশ হিসেবে এই অঞ্চল ভেঙে কক্সবাজার জেলা আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।