পড়াশোনা

শরীয়তপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস

শরীয়তপুর জেলার নামকরণ হাজী শরীয়তউল্লাহর নামে, যিনি ফরায়েজী আন্দোলনের প্রখ্যাত নেতা ছিলেন। ধর্মীয় সংস্কার ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকার কারণে এই অঞ্চলের মানুষ তাকে গভীর শ্রদ্ধা জানায়।শরীয়তপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস১৯৭৭ সালে মহকুমা গঠনের সময় তার স্মৃতিতে এলাকাটির নাম রাখা হয় ‘শরীয়তপুর’, যা ১৯৮৪ সালে পূর্ণ জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

শরীয়তপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস?

ইতিহাসে সমৃদ্ধ বিক্রমপুরের দক্ষিণাঞ্চল এবং প্রাচীন বরিশাল জেলার ইদিলপুর পরগণার কিছু অংশ মিলিয়ে গঠিত হয়েছে বর্তমান শরীয়তপুর জেলা। এই অঞ্চলের মানুষরা বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন,

যা জাতির ইতিহাসে গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। স্বাধীনতা অর্জনের পর শরীয়তপুর তখন ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

পরে, ১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও প্রখ্যাত সমাজ সংস্কারক হাজী শরীয়ত উল্লাহর নামে এ অঞ্চলের নামকরণ করা হয় ‘শরীয়তপুর’।

পরবর্তীতে, ১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের অংশ হিসেবে শরীয়তপুর মহকুমাকে পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই জেলার গঠনে ইতিহাস, সংগ্রাম এবং সংস্কৃতির এক অনন্য সম্মিলন ঘটেছে।

শরীয়তপুর জেলার প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস

প্রাচীনকালে বর্তমান শরীয়তপুর অঞ্চল তথা বৃহত্তর মাদারীপুর মহকুমা “ইদিলপুর” নামে পরিচিত ছিল, যা কোটালিপাড়া অথবা চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

পরবর্তীতে এটি বিক্রমপুর রাজ্যের অন্তর্গত হয়ে “কেদারপুর” নামে পরিচিতি পায়। এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন বারোভূঁইয়ার অন্যতম বিপ্লবী চাঁদ রায় ও কেদার রায় (মৃত্যু: ১৬০৩)।

তারা দক্ষিণ বিক্রমপুরের আড়া ফুলবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, যা বর্তমানে নড়িয়া উপজেলার একটি নদীতে বিলীন অংশ। কেদার রায় রায়পুর নামের একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজকের পুটিজুরি নামে পরিচিত।

কেদার রায়ের স্মৃতি এখনো টিকে আছে ‘দিগম্বরীর দীঘি’র মাধ্যমে। যা তার স্ত্রী বা পূজিত দেবীর নামে খনন করেছিলেন। পাশ্ববর্তী ‘ভিয়া বাড়ি’ নামে পরিচিত একটি পুরনো বাড়ির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যেটি ধারণা করা হয় “ভুঁইয়া বাড়ি”র অপভ্রংশ।

কেদার রায়ের পরিকল্পিত বাসভবনের চারপাশে একটি পরিখা খনন করা হয়েছিল, যার কিছু ভগ্নাবশেষ এখনও কেদার রায়ের বাড়ির বেড় (পরিখা) নামে পরিচিত। কেদার রায় মৃত্যুবরণ করলে তার নির্মাণাধীন বাসভবন অসমাপ্ত অবস্থায় থেকে যায়।

মুঘল আগমন ও সংঘর্ষ

মুঘল সেনাপতি মানসিংহ যখন বিক্রমপুর আক্রমণ করেন, তখন কেদার রায়ের বাহিনীর সঙ্গে ফতেজঙ্গপুরে (পুরনো নাম শ্রীনগর) একটি ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

যুদ্ধে মুঘল বিজয়ী হলে মানসিংহ এই স্থানটির নাম দেন ‘ফতেজঙ্গপুর’। এখানেই রয়েছে ঐতিহাসিক নাককাটা বাসুদেবের প্রস্তর মূর্তি। কেদার রায়ের মৃত্যুর পর মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে (গভর্নর ইসলাম খান, ১৬০৮–১৬১৩)

মুঘল শাসনের ভিত্তি দৃঢ় হয় এবং এই অঞ্চল মুঘলদের অধীনে চলে যায়। ইসলাম খানের পর আরও একুশজন গভর্নর ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চল শাসন করেন।

ব্রিটিশ শাসনকাল ও প্রশাসনিক পরিবর্তন

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর ১৭৬৫ সালে শরীয়তপুর অঞ্চল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে আসে। ফরিদপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে এটি ঢাকা নিয়াবতের আওতায় ছিল।

১৮৬৯ সালে একে বাকেরগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হলেও জনসাধারণের দাবির মুখে ১৮৭৩ সালে এটি পুনরায় ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার অংশে পরিণত হয়।

আরও পড়ুনঃ নড়াইল জেলার নামকরণের ইতিহাস

স্বাধীনতা আন্দোলন ও আধুনিক প্রশাসনিক রূপ

ব্রিটিশ রাজের বিভক্ত বাংলার সময় (১৯০৫) এ অঞ্চলেও রাজনৈতিক চেতনা ছড়িয়ে পড়ে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় দল এই অঞ্চলে সক্রিয় ছিল। বিশেষ করে বিপ্লবী আন্দোলনে লোনসিং গ্রামের পুলিনবিহারী দাসের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।

পাকিস্তান আমলে (১৯৪৭–১৯৭১) এই অঞ্চল পাকিস্তানের অংশ ছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালে শরীয়তপুরকে একটি পৃথক মহকুমা হিসেবে গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বিশিষ্ট ফরায়েজী নেতা হাজী শরীয়তউল্লাহর নামে এই মহকুমার নামকরণ হয় ‘শরীয়তপুর’। পরে ১৯৮৪ সালে শরীয়তপুরকে পূর্ণ জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং সদর দপ্তর হিসেবে পালংকে নির্ধারণ করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button