নোয়াখালী জেলার নামকরণের ইতিহাস
নোয়াখালী জেলার নামকরণের পেছনে বেশ কিছু তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা রয়েছে। ‘নোয়াখালী’ শব্দটির উৎস নিয়ে সাধারণভাবে দুটি প্রধান মতবাদ প্রচলিত রয়েছে।
প্রথমত, ‘নোয়াখালী’ শব্দটি ‘নোয়াখালী’ থেকে এসেছে, যার মানে হল ‘নোয়া’ (নতুন) এবং ‘খালী’ (খাল বা জলাশয়)। এভাবে এটি একটি নতুন জলাশয় বা নদী সম্পর্কিত নাম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।অন্যদিকে আরেকটি মতবাদ অনুসারে, জেলার নামটি ‘নোয়া’ এবং ‘খালী’ (এক ধরনের এলাকা বা এলাকা বিশিষ্ট স্থান) থেকে এসেছে, যা ইঙ্গিত করে যে এটি একটি নতুন বসতি বা এলাকা ছিল।
সেই সময়কার ইতিহাস অনুযায়ী, নোয়াখালী অঞ্চল ছিল ভৌগোলিকভাবে একটি অনন্য স্থান, যা পরবর্তীতে সমৃদ্ধ হয়।
নোয়াখালী জেলার নামকরণের ইতিহাস?
নোয়াখালী জেলার প্রাচীন ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। এক সময় এই অঞ্চল “ভুলুয়া” নামে পরিচিত ছিল। জেলার সদর থানার আদি নাম ছিল “সুধারাম”, যা আজকের নোয়াখালী সদর হিসেবে পরিচিত।
ইতিহাসবিদদের মতে, এক সময় ত্রিপুরার পাহাড় থেকে নেমে আসা ডাকাতিয়া নদীর প্রবল স্রোতে ভুলুয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভয়াবহভাবে প্লাবিত হয়। এই প্লাবনে প্রচুর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কৃষিনির্ভর জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে তৎকালীন শাসকগণ ১৬৬০ সালে একটি বৃহৎ খাল খননের সিদ্ধান্ত নেন। এই খালটি ডাকাতিয়া নদীর অতিরিক্ত পানি রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ি ও চৌমুহনী হয়ে মেঘনা ও ফেনী নদীর দিকে প্রবাহিত করতে সহায়তা করে।
খালটি এতটাই বিশাল এবং কার্যকর ছিল যে তা অত্র অঞ্চলের জীবনযাত্রায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। স্থানীয় মানুষের ভাষায় এই নতুন খালকে বলা হত “নোয়া খাল” ‘নোয়া’ অর্থ ‘নতুন’ এবং ‘খাল’
অর্থাৎ খাল। ধীরে ধীরে “নোয়া খাল” শব্দটি প্রচলিত উচ্চারণে রূপান্তরিত হয়ে “নোয়াখালী” নাম ধারণ করে। এই নামকরণ কেবল একটি খালের স্মৃতিচারণ নয়। বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় মানুষের দৃঢ় সংকল্প ও বুদ্ধিমত্তার প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হয়।
নোয়াখালী জেলা, বর্তমান ফেনী, লক্ষ্মীপুর এবং নোয়াখালী জেলা নিয়ে একটি বৃহত্তর অঞ্চল ছিল, যা এখনও “বৃহত্তর নোয়াখালী” নামে পরিচিত। নোয়াখালী জেলার ইতিহাসের সূচনা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক আধুনিক জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই।
জেলা প্রথা প্রবর্তনের পূর্বে এটি বর্তমান কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর এবং লক্ষ্মীপুরের সমন্বয়ে গঠিত সমতট জনপদের অংশ ছিল। ১৭৭২ সালে কোম্পানীর গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস
প্রথম আধুনিক জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নেন এবং এ দেশে ১৯টি জেলা গঠন করে প্রতিটি জেলার জন্য একজন কালেক্টর নিয়োগ করেন। এর মধ্যে একটি জেলা ছিল কলিন্দা,
যা মূলত নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। তবে, ১৭৭৩ সালে জেলা প্রথা প্রত্যাহার করা হয় এবং প্রদেশ প্রথা প্রবর্তন করা হয়, যার ফলে জেলার অধীনে থাকা অফিসগুলোকে প্রদেশের অধীনে স্থানান্তরিত করা হয়।
১৮৭৭ সালে আবার জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হয়, যার ফলে বর্তমান বাংলাদেশকে ১৪টি জেলায় ভাগ করা হয়। এই ১৪টির মধ্যে ভুলুয়া নামে একটি জেলা ছিল, যা নোয়াখালী অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল।
পরবর্তীতে, ১৭৯২ সালে ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা) নামে একটি নতুন জেলা সৃষ্টি করে ভুলুয়াকে তার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সে সময়ে হাতিয়া উপজেলা বাদে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী এবং চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ অঞ্চল ভুলুয়া পরগনার অংশ ছিল।
১৮২১ সালে ভুলুয়া জেলা থেকে ত্রিপুরা জেলা আলাদা করা হয় এবং ভুলুয়া নামে একটি স্বতন্ত্র জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে, ১৮৬৮ সালে ভুলুয়া জেলার নাম পরিবর্তন করে নোয়াখালী রাখা হয়, যা আজকের নোয়াখালী জেলা হিসেবে পরিচিত।
১৮৩০ সালে, নোয়াখালীর জনগণ ওয়াহাবি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল, যা ছিল ইসলামী পুনর্জাগরণের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
এছাড়া, ১৯২০ সালের খিলাফত আন্দোলনে নোয়াখালী জেলার জনগণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল, যা ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম জনগণের অধিকার রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ছিল।
এছাড়া ১৯৪৬ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়। এই দাঙ্গার একটি বড় অংশ ছিল নোয়াখালী, যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সংখ্যাগুরু মুসলিম সম্প্রদায়ের নির্মম নির্যাতন নেমে আসে, যা “নোয়াখালী দাঙ্গা” নামে পরিচিত।
এই দাঙ্গার পর, মহাত্মা গান্ধী দাঙ্গার পরবর্তী পরিস্থিতি সরজমিনে দেখতে নোয়াখালী জেলা ভ্রমণ করেন। বর্তমানে, সোনাইমুড়ি উপজেলার জয়াগ নামক স্থানে গান্ধীজির নামে একটি আশ্রম রয়েছে, যা “গান্ধী আশ্রম” নামে পরিচিত।
আরও পড়ুনঃ পঞ্চগড় জেলার নামকরণের ইতিহাস
১৯৮৪ সালে সরকারি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী মহকুমাকে আলাদা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এরপর, নোয়াখালী জেলা পুনর্গঠিত হয়।
এবং এটি চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্ভুক্ত একটি বিশাল জেলা হিসেবে পরিচালিত হতে থাকে। ১৯৮৪ সালের পর, নোয়াখালী জেলা পাঁচটি উপজেলায় বিভক্ত ছিল, যা পরে আরও তিনটি উপজেলার সৃষ্টি হয়।হাতিয়া উপজেলা,
যার কিছু অংশ নোয়াখালী জেলার মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত ছিল, বর্তমানে মেঘনা নদী দ্বারা ঘিরে থাকা একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হিসেবে পরিচিত।