চাঁদপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত চাঁদপুর জেলা ইতিহাস, নদী ও সংস্কৃতির এক বিশিষ্ট মিলনস্থল। জেলার নাম “চাঁদপুর” কীভাবে এলো, তা নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন মত ও জনশ্রুতি।চাঁদপুর নামকরণের পেছনে জমিদার চাঁদ রায়, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব চাঁদ ফকির এবং দিল্লি থেকে আগত প্রশাসক শাহ আহমেদ চাঁদের মতো নানা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ও ঘটনার সম্পর্ক রয়েছে।
এই আর্টিকেলে আমরা চাঁদপুর নামকরণের ইতিহাস নিয়ে প্রচলিত মতসমূহকে বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করব।
চাঁদপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস?
চাঁদপুর নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামতঃ
১. চাঁদ রায়ের নামানুসারে
বার ভূঁইয়াদের আমলে চাঁদপুর অঞ্চল বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায়ের দখলে ছিল। তিনি এ অঞ্চলে একটি শাসনকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ জে. এম. সেনগুপ্তের মতে, এই জমিদার চাঁদ রায়ের নাম অনুসারেই এ অঞ্চলের নামকরণ হয় চাঁদপুর।
২. চাঁদ ফকিরের নামানুসারে
আরেকটি মত অনুযায়ী, চাঁদপুর শহরের কোড়ালিয়া এলাকার পুরিন্দপুর মহল্লার একজন স্থানীয় ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি চাঁদ ফকির এর নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নাম রাখা হয় চাঁদপুর।
৩. শাহ আহমেদ চাঁদের নামানুসারে
আরেকটি ইতিহাস অনুযায়ী, পঞ্চদশ শতকে দিল্লী থেকে আগত একজন প্রশাসক শাহ আহমেদ চাঁদ এই অঞ্চলে এসে একটি নদীবন্দর স্থাপন করেন। অনেকের মতে, তাঁর নাম অনুসারেই এই স্থানের নামকরণ হয় চাঁদপুর।
প্রাচীন ইতিহাস
বর্তমান চাঁদপুর জেলা প্রাচীন বঙ্গে সমতট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে চৈনিক পরিব্রাজক ওয়ান চোয়াং সমতট অঞ্চলে আগমন করেন। তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে তিনি সমতটকে সমুদ্র তীরবর্তী নিম্ন আদ্র-ভূমি হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা বর্তমান চাঁদপুর অঞ্চলকে নির্দেশ করে।
এই অঞ্চলে গুপ্ত, পাল এবং সেন রাজবংশের শাসনকাল অতিবাহিত হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে এই এলাকার কোনো স্বতন্ত্র প্রাচীন নাম এখনও নির্ধারণ করা যায়নি।
মুসলিম শাসনামল
১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ের পর চাঁদপুর অঞ্চল মুসলিম শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। বিশেষত সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ এই অঞ্চলে শাসন করেছেন বলে ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে।
হাজীগঞ্জের ফিরোজশাহী মসজিদ, যা ফখরুদ্দীনের দেওয়ান ফিরোজ খান লস্কর নির্মাণ করেন, মুসলিম স্থাপত্যের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে।
মুঘল আমল
১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবরের রাজস্বমন্ত্রী রাজা টোডরমল ১৯টি প্রশাসনিক বিভাগ প্রবর্তন করেন। এর মধ্যে একটি ছিল সোনারগাঁও সরকার, যাতে ত্রিপুরা ও নোয়াখালী অন্তর্ভুক্ত ছিল। চাঁদপুর এই ত্রিপুরা অঞ্চলের অংশ ছিল।
হাজীগঞ্জ উপজেলার অলিপুর গ্রামে মুঘল আমলে শাসক আব্দুল্লাহ তাঁর প্রশাসনিক সদর দপ্তর স্থাপন করেন। এখানকার উল্লেখযোগ্য মুঘল স্থাপত্যের মধ্যে রয়েছে আলমগীরি পাঁচ গম্বুজ মসজিদ, শাহাজাদা সুজার নির্মিত তিন গম্বুজ মসজিদ ও অলিদের মাজার।
নামকরণের ইতিহাস
চাঁদপুর নামকরণের বিষয়ে নানা মত প্রচলিত রয়েছে।
- ইতিহাসবিদ জে. এম. সেনগুপ্ত মনে করেন, এই অঞ্চলের নামকরণ হয় বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায়ের নাম অনুসারে।
- অন্য মতে, কোড়ালিয়া এলাকার চাঁদ ফকিরের নামানুসারে এ নামকরণ হয়।
আরেক মতে, দিল্লি থেকে আগত প্রশাসক শাহ আহমেদ চাঁদ ১৫শ শতকে এ অঞ্চলে একটি নদীবন্দর স্থাপন করেন এবং তাঁর নামেই “চাঁদপুর” নামটি প্রচলিত হয়।
ব্রিটিশ শাসনামলে চাঁদপুর
১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ জরিপকারী মেজর জেমস্ রেনেল যে মানচিত্র এঁকেছিলেন তাতে “চাঁদপুর” নামে একটি অখ্যাত জনপদের উল্লেখ ছিল।
সেই সময় চাঁদপুরের অফিস-আদালত ছিল দক্ষিণের নরসিংহপুর নামক স্থানে, যা বর্তমানে নদীগর্ভে বিলীন। তখন পদ্মা ও মেঘনার সঙ্গমস্থল ছিল বর্তমান অবস্থান থেকে প্রায় ৬০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে।
১৮৭৮ সালে চাঁদপুর মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮৯৬ সালের ১ অক্টোবর চাঁদপুর শহরকে পৌরসভা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তান আমল
১৯৬০ সাল পর্যন্ত চাঁদপুর ছিল বৃহত্তর ত্রিপুরা জেলার অংশ। সে সময় ত্রিপুরা জেলা গঠিত ছিল ৪টি মহকুমা নিয়েঃ
১. সদর উত্তর
২. সদর দক্ষিণ
৩. ব্রাহ্মণবাড়িয়া
৪. চাঁদপুর
চাঁদপুর মহকুমায় ছিল ৫টি থানাঃ চাঁদপুর, ফরিদগঞ্জ, হাজীগঞ্জ, কচুয়া ও মতলব।
আরও পড়ুনঃ মাদারীপুর জেলার নামকরণের ইতিহাস
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা
- মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় চাঁদপুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত চাঁদপুর ক্রমাগতভাবে শত্রুমুক্ত হতে থাকে।
- ৭ এপ্রিল সকাল ৯টায় পাক হানাদার বাহিনী প্রথম পুরাণবাজারে বিমান হামলা চালায়।
- মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি যুদ্ধ সংঘটিত হয় বাবুরহাট, টেকনিক্যাল হাইস্কুল, বাখরপুর মজুমদার বাড়ি, ফরিদগঞ্জের গাজীপুর ও ওটতলী এলাকায়।
- ৮ ডিসেম্বর রাতে চাঁদপুর সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়।
জেলা হিসেবে স্বীকৃতি
১৯৮৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর মহকুমাকে জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তখন থেকেই চাঁদপুর একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।